প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
প্রথমেই বলে রাখি, আমার পড়ালেখার বয়সে কখনোই বিতর্ক প্রতিযোগিতা কী জিনিস জানতে পারেনি। হয়তো বা ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক চর্চা না থাকার কারণে আমরা সদরকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করলেও বঞ্চিত হয়েছি। কিন্তু এখন কি তা হচ্ছে? আমি খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, উপজেলা পর্যায়ে হাতেগোণা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানই বিতর্কসহ সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যে আন্তঃস্কুল পর্যায়ে এসব আয়োজন করে না। কিন্তু সরকারের শিক্ষা নিয়ে বাস্তবধর্মী চিন্তা এবং কথিত মুখস্থবিদ্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে নতুন পাঠক্রম শুরু করেছে। সেই পাঠক্রমে শিক্ষার্থীদের অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে এসব বিষয়ে চর্চা করতে হচ্ছে। ফলে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরাও এখন এগিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে।
দ্বাদশ পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এখনো পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে অংশ না নেয়ার জড়তা লক্ষ্য করেছি। অথচ তারা ভুলেই গেছেন এগুলো এখন ওইসব শিক্ষার্থীর জন্যে লেখাপড়ার অংশ হয়ে গেছে। আশা করছি, আগামীতে এসব প্রতিষ্ঠানের বোধোদয় জাগ্রত হবে এবং শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সুযোগ করে দিবে।
এখন আসি কেনো বিতর্কে অংশ নিবেন এই কথায়। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কাজ করতে গিয়ে আমার উপলব্ধি হলো : সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে একমাত্র বিতর্ক হলো এমন একটি মাধ্যম, যেখানে এর চর্চার কারণে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ সহায়ক হয়। বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিষয়, স্ক্রিপ্ট করা এবং বক্তব্য উপস্থাপন ও প্রতিপক্ষকে প্রশ্নবাণে পরাভূত করা এবং সঠিক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে বিজয় নিশ্চিত করতে প্রতিটি পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণে পড়ালেখা করতে হয়। কোনো সময়ে বিতর্কে অংশগ্রহণ ও প্রশিক্ষণ নেননি, কিন্তু কাজ করতে গিয়ে তিনি একজন ভালো স্ক্রিপ্ট লেখক হয়ে গেছেন--এমন ব্যক্তি রয়েছেন। এসব কিছু পড়ালেখার কারণেই হয়েছে। বিতর্ক প্রতিযোগিতা একসময় টেলিভিশননির্ভর থাকলেও গত দেড় দশক ধরে গণমাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত হওয়ায় বলতেই হয়, এখন এর পালে হাওয়া লেগেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বিতার্কিকরা এখন অতি সহজেই সার্চইঞ্জিন ‘গুগল’ ব্যবহার করে বিতর্কের বিষয়ে না জানা তথ্যসংগ্রহ করতে পারছে। ইউটিউব দেখে বিতর্ক করার রসদ পাচ্ছে।
ইউটিউবের কথা আসায় বলতেই হয়, পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা বালিথুবা আঃ হামিদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনীতিবিদ জিএম হাসান তাবাচ্চুমের মেয়ে তানজিনা তাবাচ্চুমের কথা। ছোটবেলা থেকে পরিবারের সংস্পর্শে সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি হলেও একমাত্র বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সে নিজেকে খুঁজে পায়। বর্তমানে তার ইউটিউবে ভিউআর এবং সাবস্ক্রাইবার দেখলে বোঝা যায় সে কতটা এগিয়ে গিয়েছে। সে কথা বলেই একটুকু আসতে পেরেছে। সম্প্রতি বালিথুবা আঃ হামিদ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর চমৎকার আবৃত্তি শুনে উপস্থিত গুণীজনের মতো আমিও মুগ্ধ হয়েছি। যদিও এই প্রতিভা বিকাশে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের কোনো ভূমিকা রয়েছে কি না আমি জানি না। তবে অভিভাবকদের সাথে কথা বলে তাদের আগ্রহের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছি।
গত তিন দশক ধরে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে প্রশাসনসহ সর্বস্তরের আলোকিত মানুষগুলোর মধ্যে যাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছি, তাঁদের কথা শুনে এবং তাঁদের শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জেনে এতটুকু বুঝেছি যে, অধিকাংশজনেরই তাঁদের শিক্ষাজীবনে শ্রেণিতে রোল নম্বর ১, ২ বা ৩ ছিলো না। তার মানে ভালো ছাত্ররাই যে সমাজে সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে তা সঠিক নয়। পরিশ্রম এবং মেধার বিকাশের মাধ্যমেই জীবনে সাফল্য এসেছে।
সিকেডিএফ চাঁদপুর সদরের আয়োজনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া বিতর্ক প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ এবং প্রশিক্ষণে ব্যাপক উপস্থিতি প্রশাসনসহ আয়োজকদের মুগ্ধ করেছে। আমার আবেদন, শিক্ষা বিভাগ এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় ভবিষ্যতে প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হোক, যেটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সর্বোপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও বিতর্কসহ সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী করে তুলবে।
বিতর্ক চর্চা শুধু মেধা-মননের বিকাশ ঘটায় না, সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস জোগায় বিতর্ক। তীক্ষè উপস্থিত বুদ্ধি বাড়ে বিতার্কিকদের। ফলে যে কোনো সময়ে তারা অন্তত কথার মারপ্যাঁচে নিজেদের যোগ্যতার বিষয়টি উপস্থিতিদের বোঝাতে সক্ষম হয়। বিতর্ক চর্চা বিতার্কিকদের জানার আগ্রহকে জাগিয়ে তোলে। যা তার ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মেধাবী ও পরিশ্রমী করে তোলার জন্যে সর্বোপরি সাহসী করে তোলার জন্যে বিতর্কে অংশগ্রহণ জরুরি।
প্রবীর চক্রবর্তী : সভাপতি, চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ), ফরিদগঞ্জ উপজেলা শাখা, চাঁদপুর।