প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
ভাষা ভাবের বাহন। মানুষের মুখের ভাষা দিয়ে তার মনের ভাব কেবল নয়, রুচি এবং বংশ পরিচয়ও জানতে পারা যায়। উপরন্তু মুখের ভাষাশৈলীর মাধ্যমে ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা ও মেধার বিজ্ঞাপনও হয়। কাজেই মুখের ভাষাশৈলী নিয়ে ব্যক্তির সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক। বিতর্কের মতো নান্দনিক এক বাচিকশিল্পে ভাষার শিল্পসম্মত ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ভাষার মাধ্যমে শুধু মনের ভাব প্রকাশ করলেই হবে না, ভাষাকে শিষ্টাচার এবং সামাজিক জীবনবোধের মাধ্যম হিসেবেও চিন্তা করার অবকাশ আছে। যে কোনো যুক্তিকে উপস্থাপনকালে উপযুক্ত শব্দটা প্রয়োগ করা উচিত। যেমন আজকাল যুবতী শব্দটাকে আমরা এড়ানোর কথা বলি। কেননা শব্দটায় যৌনতার আভাস মেলে। সে স্থলে তরুণী শব্দের ব্যবহার বিতর্ককে শিল্পসম্মত করে তোলে। যে বক্তা যুবতী আর তরুণী শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্র চেনে না তার পক্ষে বিতার্কিক হওয়ার চেষ্ট করাটাই বৃথা। অনুরূপভাবে মা আর বাবার স্ত্রী শব্দ দুটি একই অর্থ বহন করলেও সবক্ষেত্রে মা-এর বিকল্প বাবার স্ত্রী শব্দটির ব্যবহার চলে না। অচেনা নারীকে মা জল দাও বলা যায়। কিন্তু তাকে যদি কেউ ‘হে আমার বাবার স্ত্রী’ বলে সম্বোধন করে তবে তাকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না। বিতর্কের ভাষায় ধর্ষণ না বলে তাকে যৌন নির্যাতন বলাটাই অনেকের কাছে শ্রেয় মনে হয়। সরাসরি আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার বিতর্কে পরিহারযোগ্য। যেমন : ‘আমার প্রতিপক্ষীয় বক্তাবন্ধুরা বোকা, তারা আমাদের কথাই বুঝে উঠতে পারছেন না’ কথাটা এভাবে না বলে যদি বলা যায়, ‘আমার প্রতিপক্ষীয় বক্তাবন্ধুরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন’ তাহলে তাতে নান্দনিকতা তৈরি হয় এবং ব্যক্তি-আক্রমণের আবহ থাকে না। আবার কেউ যদি বলে, ‘চাকরিহীনতাই আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার মূল কারণ’, তবে তা হয়ে যায় চাঁছাছোলা। কিন্তু যদি বলতো, ‘কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতাই আমাদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ’, তাহলে শ্রোতার শ্রবণ মুগ্ধ হয়ে যেতো।
বিতর্ক হলো মেধাবীদের শিল্প। এখানে যুক্তিকে ভাষার চাতুর্যে উপস্থাপন করাই হলো রেওয়াজ। কেউ আটপৌরে ভাষা দিয়ে যেমন বিতর্ককে নষ্ট করে তুলতে পারে, তেমনি কেউ পরিশীলিত ভাষার ব্যবহারে বিতর্ককে করে তুলতে পারে অনুকরণীয় আর উপভোগ্য। বাংলা ভাষায় স্বামী অর্থে ভাতার শব্দটির প্রচলন আছে। কিন্তু প্রমিত ভাষায় ভাতার শব্দের ব্যবহার গালাগালের মতোই মনে হয়। কাজেই কোনো বিতার্কিক যদি তার বক্তব্যে ভাতারের উল্লেখ করে তবে তা অশ্লীলতার দায়ে দুষ্ট হতে পারে। বক্তব্যের ভাষা লেখ্য ভাষা থেকে ভিন্নতা বহন করলেও বিতর্কে প্রমিত ভাষাই কেবল যে ব্যবহার করতে হবে তা নয়, বরং অনেক প্রমিত শব্দও ক্ষেত্র বিশেষে পরিত্যাজ্য। কেননা পরিস্থিতি এবং পাত্রবিশেষে বিতর্কে ভাষাশৈলীর প্রয়োগ করা দরকার হয়।
বিতর্কের ভাষায় যত বেশি হিংস্রতা ও ভালগারিজম এড়ানো যায় ততই তা মঙ্গলজনক। কেননা, বিতর্ক হচ্ছে সভ্যতার শিল্প। এখানে শ্লেষের মধ্যেও থাকা চাই শিষ্টাচার। আমরা বলতে পারি না, আপনারা চোখ থাকতেও অন্ধ। বরং আমাদের বলতে হয় যারা জেগে ঘুমায় তাদের জাগানো কঠিন। এই যে প্রয়োগের ভিন্নতা এতে ভাষাশৈলীর কোমল কিন্তু কার্যকর ভঙ্গি তৈরি হয়। উপরোক্ত দুটি উদাহরণেই প্রমিত ভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার আছে কিন্তু প্রয়োগশৈলীতে কিছুটা শোভন ভঙ্গির কারণে শেষোক্ত শৈলীটাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কখনো কখনো প্রতিপক্ষের যুক্তির জবাবে পাল্টা জিজ্ঞাসা হেনে আমরা বলি, প্রতিপক্ষীয় বক্তা বন্ধুদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম। আশা করি উত্তর দিয়ে যাবেন। কিন্তু আমরা যদি তা না বলে এভাবে বলতে চেষ্টা করি, আশা করি বিজ্ঞ বন্ধুদের কাছে আমাদেরর জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়া যাবে, তাহলে তাতে উগ্রতার দোষে বক্তব্য দুষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকবে না। বরং মার্জিত প্রশ্নের গুণে বিচারক ও দর্শকের কাছে এ ধরনের প্রকাশভঙ্গি অভিনন্দিত হতে পারে।
একজন বিতার্কিকের ভাষা আত্মজাহিরের মতো অশোভন হবে না। তার মনে থাকবে আত্মবিশ্বাস, কিন্তু মুখে থাকবে বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ। একজন বিতার্কিক বলবেন না, আমরা জানি। তিনি বলবেন, এপিজে আব্দুল কালামের বরাতে আমরা জেনেছি, স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখে না বরং স্বপ্ন ঘুমাতে দেয় না। একই বিষয় শুধু বলার ঢংয়ের ভিন্নতার কারণে তা শোভন হয়ে উঠে। বাঙালিকে নিয়ে একটা অপবাদ প্রচলিত আছে। বাঙালি নাকি কণ্ঠে কর্কশ। এক্ষেত্রে রাশানরা এগিয়ে। তারা কথায় কথায় ইজবিনিয়েতে পাজালুস্তা বলে। অর্থাৎ ইংরেজি করলে দাঁড়ায়, এক্সিউজ মি। কিন্তু বাঙালির কথায় সেই প্রকাশটা নেই। বাঙালি অচেনা কাউকে জিজ্ঞেস করার সময় বলে, ভাই, কয়টা বাজে? কিংবা আংকেল ঘড়িতে সময় কতো? যেন তিনি সে জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে বাধ্য। এক্ষেত্রে বিতর্কশিল্পীরা ভিন্ন। তাদের বলার ভঙ্গিতে আদব-কায়দার ঘাটতি থাকে না। তাদেরকে বলতে হয়, আমি সম্মানীয় সভাপ্রধানের কাছে মার্জনা চেয়ে বলি, আমার প্রতিপক্ষীয় প্রথম বক্তাবন্ধু একটু আগে যা বলে গেলেন তা সঠিক নয়। আমি বিনয়ের সাথে তার বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করি। এভাবে বলাটাই একজন বিতার্কিকের প্রকৃত সংস্কৃতি।
বিতর্ক কেবল কোন প্রতিযোগিতা মাত্র নয়। বিতর্ক একটা প্রজন্মণ্ডবিনির্মাণ প্রকল্প। এখানে শুধুমাত্র বিজয়ী হওয়া কারো লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। বরং নিজেকে গড়ে তোলাটাই বিতর্কের মহান ব্রত। এখানে যে হারে সে-ও বিজয়ী হয়। হেরে গিয়ে সে যা অর্জন করে তা-ই তাকে এগিয়ে দেয় পরবর্তী ক্ষেত্রে। সুতরাং একজন বিতার্কিকের ভাষার ভাণ্ডার প্রশস্ত ও প্রগাঢ় হওয়া উচিত। অনেক সময় মানুষ না বলে যা জিতে বরং বলে তার দ্বিগুণ হারায়। এ হারা কেবল উপযুক্ত ভাষাশৈলীর ঘাটতির কারণে। কাজেই যথাস্থানে যথা ভাষাশৈলীই হয়ে উঠুক ঋদ্ধ বিতার্কিকের সমৃদ্ধ হাতিয়ার।
লেখক : উপদেষ্টা, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ও চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন; অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি।