বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

বিতর্কে আদর্শ যুক্তি তৈরির কৌশল
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

যুক্তি হচ্ছে বিতর্কের প্রাণ। যুক্তি ছাড়া বিতর্ক সম্ভব নয়। একজন বিতার্কিককে নিজের বক্তব্যকে উপাদেয় ও আকর্ষণীয় করে তুলতে ক্ষুরধার যুক্তি নির্মাণ করতে হবে। যুক্তিকে ক্ষুরধার না করতে পারলে বিতর্কে বিচারক ও দর্শকের মন জয় করা সম্ভব নয়। আদর্শ যুক্তিতে মহাজ্ঞানীদের উক্তি থাকতে পারে। তবে সেই উক্তি কখনোই দুই-এক লাইনের চেয়ে বড় যাতে না হয়। উক্তি দুই-এক লাইনের চেয়ে বড় হলে তার সারমর্মটা নিজের ভাষায় বলতে হবে। সেক্ষেত্রে সময় কম নষ্ট হবে। যুক্তিকে অকাট্য করে তুলতে উক্তিকে প্রাসঙ্গিক হতে হবে। এ যেন ধান ভানতে শিবের গীত না হয়। একটা যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে তাতে তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয় থাকতে হবে। লঘু কথায় যুক্তি তৈরির চেষ্টা কলতলার কলহে তর্কের শামিল হয়ে যাবে। তথ্য দিতে গেলে তা যেন সঙ্গত মাত্রার হয়। পরিসংখ্যানের ভারে যদি বিতর্কের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে তবে তা ব্যর্থতার নামান্তর। আদর্শ যুক্তিতে পরিসংখ্যান থাকবে পরিমিত মাত্রায়। যুক্তি নির্মাণে যত বেশি প্রতিপক্ষের কথাকে সংশ্লিষ্ট করা যাবে ততই ভালো। প্রতিটি যুক্তির দৈর্ঘ্য যাতে ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি না হয়। কেননা কেবলমাত্র একটা যুক্তি দিয়ে বিতর্কে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়।

মনের ভেতর যুক্তির যে ঝড়ের প্রবাহ তৈরি হয় তাকে মুক্তি দিতেই হবে সময়কে জয় করে। প্রতিটি যুক্তিকে সহজবোধ্য করে তুলতে দরকার হয় তত্ত্বের। তত্ত্ব দিয়ে যত সহজে একটা সমস্যাকে প্রকাশিত করা যায় তা আর কোনোকিছুতেই এত সহজে ফোটানো যায় না। যেমন ধরা যাক, সম্পদের অভাব নয়, সম্পদের সুষম বন্টনহীনতাই আমাদের দারিদ্র্যের কারণ। এই বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখতে গেলে যদি কেউ বলে, আমরা আজকের প্রস্তাবনাকে সমর্থন করে অমর্ত্য সেনের মতো বলতে চাই, গণতন্ত্রের অভাবেও দেশে দুর্ভিক্ষ হয়। এই তত্ত্ব ব্যবহার করার পর বক্তাকে আর তেমন কিছুই খোলসা করার দরকার হয় না। কোনো কোনো সময় যুক্তিকে দৃশ্যমান করে তোলার জন্যে বাস্তব উদাহরণের দরকার হয়। বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে বক্তার কথার দৈর্ঘ্য কমানো যায়। যেমন ধরা যাক, দেশকে আগাতে হলে আজ প্রতিরক্ষা নয় অর্থনীতির ওপর জোর দেওয়া উচিত। এই প্রস্তাবনায় কেউ যদি বলে, আসুন আমরা আজকের জাপানের দিকে তাকাই। প্রতিরক্ষা নয়, টেকসই অর্থনীতিই আজ তাদের অগ্রগামী করে রেখেছে। এই উদাহরণের পর আমাদের আর এ বিষয়ে চিন্তা করতে হয় না, প্রতিরক্ষা কমালে দেশকে কীভাবে সুসংহত রাখা যায়। কাজেই যে কোনো ভালো যুক্তির বড় শক্তি হলো বাস্তব উদাহরণ।

যুক্তিকে ক্ষুরধার করতে হলে ভাষায় কখনো কখনো শ্লেষের ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ে। ভাষায় এই শ্লেষের ব্যবহার আমরা বাংলা বাগধারা এবং প্রবাদণ্ডপ্রবচনের মধ্যে ভালো পাই। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো শুনি তবে বুঝবো, তাঁর ভাষণে ব্যবহৃত বাগধারা-প্রবাদণ্ডপ্রবচনের একটা শ্লেষ তৈরির শক্তি ছিলো। যেমন তিনি বলতেন, যেই না মাথার চুল তার আবার লাল ফিতা। এতে বুঝা যায়, প্রতিপক্ষের প্রতি শ্লেষ হেনে তিনি তাঁর ভাষণকে করে তুলতেন আকর্ষণীয় ও লক্ষ্যভেদী। কাজেই যে কোনো বক্তার বক্তব্যে কিছু না কিছু শ্লেষাত্মক ভাষার অলঙ্কার থাকা জরুরি। যেমন : ঘটি না ডুবলেও নামে তাল পুকুর নিয়ে আমার প্রতিপক্ষ বন্ধুরা উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছেন। আগে তো সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করেন।

যুক্তিকে নির্মাণ করতে গেলে আবেগ থাকা চলবে না। সম্পূর্ণ নির্মোহ হয়েই যুক্তি নির্মাণ করতে হবে। কেননা কোন্ যুক্তির পেছনে আবার প্রতি-আক্রমণ থাকে তা বলা যায় না। যে যুক্তির পেছনে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের মজুদ আছে, যে যুক্তি পরবর্তী যুক্তির ভিত রচনা করে, সে যুক্তিকেই বেছে নেওয়া উচিত বিতর্কমঞ্চের যুক্তি-রণে।

যুক্তি প্রদানের ধারাবাহিকতা একজন আদর্শ বক্তার জন্যে অত্যন্ত জরুরি। অসংবৃত ও অবিন্যস্ত যুক্তি বক্তব্যকে বিশৃঙ্খল করে তোলে। একটা জুতসই যুক্তি নির্মেদ হবে। কথার ঘনঘটা সেখানে থাকবে না। বরং কত অল্প কথায় একটা যুক্তিকে ধারালো করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। প্রতিটি যুক্তি এমনভাবে তৈরি করা দরকার যাতে আরও একবার ব্যাকআপ দেওয়া যায়। যুক্তির ভাষা প্রমিত হবে যেমন তেমনি তাতে থাকবে নিজস্বতার নির্যাস। বইয়ের ভাষায় যুক্তি নির্মাণ করতে গেলে তা অনেকাংশে পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি বজায় রাখতে পারে না। আমরা একটা উদাহরণ এখানে টানতে পারি। যেমন একটা বিষয়ের কথা ভাবি যেখানে বলা হলো, ‘আজকের প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে মোবাইল আসক্তি কমাতে হবে।' এখানে কেউ যদি মোবাইল আসক্তি কমানোর কথা বলতে গিয়ে প্রজন্মকে মোবাইল হতে দূরে রাখার কথা বলে তবে তা বাস্তবসম্মত হবে না। বরং মোবাইল সাথে রেখে তাতে গেম খেলা কিংবা অশ্লীল ভিডিও দেখা কমানো বা বন্ধ করার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। অর্থাৎ মোবাইল গেমিং বন্ধ করতে হবে। কাজেই বইয়ের ভাষায় কথা বলতে গেলে প্রজন্মকে মোবাইল থেকে দূরে রাখতে হবে, যা বাস্তবতার নিরিখে যায় না। সুতরাং যুক্তি বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বাস্তবতার ওপর জোর দিতে হবে। অনেকেরই প্রবণতা আছে, একটি যুক্তি ফর্মুলেট করতে গিয়ে বাগাড়ম্বরতার আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে বক্তাকে পরিমিতিবোধের আশ্রয় নিতে হবে। যুক্তি প্রদানে কখনো কখনো নাটকীয়তার আশ্রয় নিতে হয়। সরাসরি কোনো যুক্তিকে তথ্য আকারে পরিবেশন না করে একটু নাটকীয়তা তৈরি করা গেলে তাতে শ্রোতা ও বিচারকবৃন্দের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়।

মনে রাখতে হবে, বিতর্ক হচ্ছে যুক্তির প্রদর্শনী। যুক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে শ্রোতাদের মনে হয়, এমন কথা তারা কখনো শোনেননি। কাজেই নিজের বক্তব্যকে সর্বদা আকর্ষণীয় করে তুলতে কিছু গল্প বা কাহিনীকে যুক্তির মধ্যে ছোট করে ঢোকাতে হবে। আখ্যানে অভ্যস্ত মানুষ যখন আখ্যানছলে যুক্তি শুনবে তখন তাতে মজে গিয়ে প্রভাবিত হবে। তখন মনে হবে এর চেয়ে সত্য আর নেই। এটাই হলো বিতর্কের বা যুক্তির লক্ষ্য।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়