প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
বিটিভিতে ‘জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক’ বা শুক্রবারে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ‘ছায়া সংসদ’ হয়তো অনেকেই দেখে থাকেন। দেখে হয়তো মাঝে মাঝে মনেও হয়, ‘ইশ, বিতার্কিকেরা কত সুন্দর করে কথা বলে! আমিও যদি এভাবে যুক্তি দিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম!’
বিতার্কিক হওয়া খুব কঠিন কিছু না। একটু কৌশল, শ্রম আর অনুশীলনের মাধ্যমে আপনিও হয়ে উঠতে পারবেন তুখোড় একজন বিতার্কিক। বিতর্ক যারা করতে চান বা যারা নতুনভাবে শুরু করছেন, বিশেষভাবে তাদের জন্য আজকের লেখাটি। যারা নিয়মিত করছেন তারাও একটিবার পড়ে ফেলতে পারেন। নতুন কিছু কৌশলও হয়তো জানা হয়ে যেতে পারে!
বিতর্ক হচ্ছে তর্কের খেলা। একটি নির্ধারিত বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে নিজের যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই বিতর্কের মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে যুক্তির আয়নার নিজের ভাবনাগুলোকে প্রতিফলিত করা যায়। এর ফলে বাড়ে চিন্তার পরিধি, জ্ঞান আর প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান। একটি বিষয়কে বৃত্তের বাইরে গিয়ে কীভাবে আর কতভাবে ভাবা যায়, তা একজন বিতার্কিকের থেকে ভালো কেউ বলতে পারবে না। তবে, কীভাবে ভালো বিতার্কিক হয়ে ওঠা যায়, তার আগে চলুন সংক্ষেপে জেনে আসি বিতর্কের প্রকারভেদ।
সাধারণত প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতামূলক--এই দুই শ্রেণীর বিতর্ক হয়ে থাকে। প্রদর্শনী বিতর্কের মাঝে রম্য বিতর্ক, প্ল্যানচেট বিতর্ক ও জুটি বিতর্ক এবং প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কের মাঝে সংসদীয় বিতর্ক, সনাতনী বিতর্ক ও বারোয়ারি বিতর্ক প্রচলিত রয়েছে। বিতর্কের প্রকারভেদ নিয়ে বিস্তারিত আমরা অন্য কোনোদিন জানবো। আজ আমরা একদম নবিস থেকে কীভাবে একজন বিতার্কিক হয়ে ওঠা যায় তা নিয়ে আলোচনা করবো।
একজন ভালো বিতার্কিক হতে হলে যে বিষয়গুলো আয়ত্তে না থাকলেই নয়, সেগুলো হচ্ছে--
১) বিষয় জ্ঞান : বিতর্ক করতে হলে প্রয়োজন তথ্যবহুল যুক্তি। প্রতিপক্ষের যুক্তি ঘায়েল করে বিচারকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজন ঠিক বিষয়ে ঠিকঠাক যুক্তি-তথ্য প্রদান। আর সেজন্যে প্রয়োজন বিষয়বস্তুর ওপর জ্ঞান থাকা। বিতর্কের বিষয় সাধারণত সমসাময়িক বিষয়ের উপর বেশিরভাগ সময় হয়ে থাকে। সুতরাং, পত্র-পত্রিকা পড়া, প্রচুর বই পড়া এবং আপডেটেড থাকলে যেকোনো বিতর্কের যেকোনো বিষয় নিয়ে সহজেই পাঁচ মিনিট কথা বলা যাবে।
২) বিতর্কের বিষয়ের ব্যবচ্ছেদ : বিতর্কের পূর্বেই একটি নির্ধারিত বিষয় দেয়া থাকে। বিতর্কভেদে সেই বিষয় একদিন, এক ঘন্টা, আবার অনেক সময় বিতর্ক শুরুর মাত্র ১৫ মিনিট আগেও দেয়া হয়। সুতরাং, স্বল্প সময়ের মাঝে পুরো বিতর্কটি ধরতে পারা এবং নিজের দলের অবস্থান প্রতিপক্ষ থেকে দৃঢ় করার জন্যে বিতর্কের বিষয়ের সঠিক ব্যবচ্ছেদ অত্যাবশ্যক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিতর্কের বিষয়-ব্যবচ্ছেদ মানে কী। ধরুন, একটি বিতর্কের বিষয় হচ্ছে ‘ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত’। বিষয় হাতে পাওয়ার পর সর্বপ্রথম বিষয়টির মূল প্রপঞ্চগুলো চিহ্নিত করে তার পেছনে কী/কেন/কীভাবে এই প্রশ্নগুলো জুড়ে দিতে হবে। ছাত্র রাজনীতি কী? ছাত্র রাজনীতি কীভাবে আসলো? ছাত্র রাজনীতি কী কী সমস্যা সৃষ্টি করছে? ছাত্র রাজনীতি কীভাবে সমাজের উপকারেও আসে? এটি কে নিষিদ্ধ করবে? কীভাবে নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে?
এই প্রশ্নগুলো বের করার পর এবার এর উত্তরগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করলেই বিতর্কের পুরো বিষয়টি সম্পর্কে খুব সহজেই একটি ধারণা পাওয়া যাবে।
৩) কাঠামো সাজানো : পাঁচ মিনিটের বক্তব্যে যাতে দলের অবস্থান বিচারক, প্রতিপক্ষ ও দর্শকদের কাছে পরিষ্কার হয়, সেজন্য প্রয়োজন কাঠামোবদ্ধ বিতর্ক করা। বিতর্কের ভাষায় একে ‘কেস ফ্রেমিং’ বলে। বিতর্কের শুরুতে প্রতিপক্ষের পূর্ববর্তী বক্তার যুক্তিগুলোর ভুলগুলো দেখিয়ে বক্তব্য শুরু করা, নিজের যুক্তিগুলো প্রতিষ্ঠিত করা ও নিজের দলের যুক্তিগুলো কেন প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলোর চেয়ে ভালো সেই সম্পর্কে একটি তুলনামূলক আলোচনা করে নিজের দলের অবস্থান দৃঢ় করা--এ সবই নির্ভর করে ফ্রেমিংয়ের উপর। অর্থাৎ, কোন্ জিনিসের পর কোন্ জিনিস কীভাবে বলবে, সেটিই হচ্ছে বিতর্কের ফ্রেমিং। বিষয়জ্ঞান ভালো থাকার পরেও অনেক সময় ঠিকভাবে ফ্রেমিং করা না হলে নিজেদের দলীয় অবস্থান পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয় না।
৪) নির্ধারিত বক্তার দায়িত্ব পালন : সাধারণত বিতর্কে প্রতি দলে তিনজন করে বক্তা থাকেন। তিনজন বক্তার দলীয় ভূমিকাও আলাদা হয়। প্রথম বক্তা বিতর্কের বিষয়টির প্রধান প্রপঞ্চগুলোর ব্যাখ্যা ও নিজেদের সপক্ষে প্রধান যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেন। দ্বিতীয় বক্তা প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলো খণ্ডনের পাশাপাশি নিজেদের যুক্তিগুলো ব্যাখ্যা ও সংশ্লিষ্ট উদাহরণ প্রদান করেন। শেষ বক্তা প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের পাশাপাশি দুই পক্ষের সার্বিক বিতর্কের হেড-টু-হেড একটি তুলনামূলক আলোচনা করে দেখিয়ে দিয়ে যান কী কারণে তাদের পক্ষের যুক্তিগুলো অধিকতর জোরালো ছিল এবং কোন্ ভুলগুলোর কারণে প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
৫) সমন্বয় : বিতার্কিক হতে হলে বিষয়ের সমন্বয়জ্ঞান থাকা জরুরি। মনে রাখবেন, একজন ভালো বিতার্কিককে সবদিকে সমান নজর দিতে হয়। ধারালো যুক্তির পাশাপাশি সমন্বয় না করলে যুক্তিগুলো তখন আর শুনতে ভালো শোনায় না। একটু সাজিয়ে গুছিয়ে, প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলোর সাথে মিলিয়ে নিজের যুক্তির দিকে, তুলনামূলক জায়গা থেকে দুই দলের পার্থক্য দেখালে সেটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয় বিচারকদের কাছে।
৬) সময়জ্ঞান : সময় গেলে সাধন হয় না। তেমনিভাবে নির্ধারিত সময়ের পরেও আর বক্তব্য গ্রহণ করা হয় না। বিতর্কের মঞ্চে তাই অত্যন্ত সময়ানুবর্তী হতে হয়। পাঁচ মিনিটের বক্তব্য যাতে পাঁচ মিনিটের মাঝেই শেষ হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রেখেই নিজের বক্তব্য দিতে হবে।
লেখক : প্রভাষক (ইংরেজি), চেড়িয়ারা স্কুল এন্ড কলেজ।