প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
বিতর্ক হলো মূলত কথা বলার অন্যতম শিল্প। বিতর্কের ভাষা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা বিতর্কে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহার করতেই হবে। পাঁচ শব্দের নির্ধারিত একটি বাংলা বাক্য বলতে প্রায় দুই বা তিনটি ইংরেজি মিশিয়ে বলার যে প্রচলন আজকাল দেখা যায় বিতর্কে তেমনটি গ্রহণযোগ্য নয়। বিতর্কের ভাষা হবে স্পষ্ট। অপ্রয়োজনীয় অলংকার দিয়ে বক্তব্যকে অতি কাব্যিক করে ফেলা উচিত নয়। বিতর্ক যুক্তিপ্রধান শিল্প।
সম্বোধন করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিশেষণ জুড়ে না দিয়ে বরং সরাসরি সম্বোধন করা উচিত। উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু বহুল চর্চিত শব্দগুচ্ছ বা বাক্য আছে। যেমন ‘তর্কের খাতিরে তর্ক না করে আমাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলুন, অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণে আজকে প্রস্তাবের পক্ষে/বিপক্ষে আমাদের অবস্থান’--এই রকম আরো বেশ কিছু বাক্য দিনের পর দিন ব্যবহার হয়ে আসছে বিতর্কে। এসব বাক্য পরিহার করাই শ্রেয়। খুব সহজভাবেই বোঝা যায় কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাতে তো কেউ এখানে আসেনি। তাই এসব বলা বাহুল্য। বিতর্কে খুব সময় অল্প, তাই বিতার্কিক তার নিজের পক্ষে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্যে পর্যাপ্ত তথ্য ও যুক্তির উপস্থাপন করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় কথা বলে সময় নষ্ট করা যাবে না।
বিচারক, স্পিকারকে শুরুতে একবার সম্বোধন করে বক্তব্য শুরু এবং শেষে একবার ধন্যবাদ দিয়ে বক্তব্য শেষ করলেই তিনি খুশি থাকবেন, এর বেশি ডাকাডাকির দরকার নেই।
বিতার্কিকের উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, ভাষার ব্যবহার হতে হবে শুদ্ধ এবং স্পষ্ট। ভালো উচ্চারণ ও শব্দচয়ন যা সহজেই শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে। কথা বলায় আঞ্চলিকতা থাকলে তা পরিহার করতে হবে। কথায় কথায় বিদেশি শব্দ ব্যবহারের মধ্যে পাণ্ডিত্যের কিছু নেই। কাজেই বিদেশি শব্দ ব্যবহার প্রবণতা পরিহার করতে হবে।
উপস্থাপনায় যেমন বিতার্কিকের উচ্চারণ, ভাষা ব্যবহার বা শব্দচয়ন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তার শরীরের ভাষা, বিতার্কিকের দাঁড়ানো, তার হাত-পায়ের নড়াচড়া, তার চোখের ভাষা, শ্রোতাণ্ডদর্শকের সাথে যোগাযোগের দক্ষতা, মাইক্রোফোনের ব্যবহার, প্রতিপক্ষ বিতর্কের প্রতি মনোভাব প্রকাশ। প্রায়শই নতুন বিতার্কিকরা তার সাথে থাকা হাত দুটি নিয়ে বিপদে পড়ে যায়। কী করবে, কোথায় রাখবে, কীভাবে নাড়বে এসব কিছু নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। এর সহজ সমাধান হলো, হাত রাখা নিয়ে না ভাবা। আরেকটা বিপদের কারণ হয় মাইক্রোফোন। মাইক্রোফোন মুখের কতটুকু কাছে রাখবে, নাকি দূরে রাখবে এসব ভাবতে ভাবতে সে যা বলে তা শ্রোতার কাছে শ্রুতিমধুর হয় না। প্রয়োজনে বিতর্কের আগেই তা অভ্যাস করে নিতে হবে। কারণ তখন অনেকের কথা বলার সময় হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়।
বিতর্ক মঞ্চে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারা জরুরি। অনেক সময় প্রতিপক্ষের কোনো কথার সাথে বিতার্কিকের দ্বিমত থাকতে পারে। তাই বলে উত্তেজিত হয়ে ওঠা চলবে না। মনে রাখতে হবে, ভিন্নমতের সহাবস্থানই সভ্যতা। বির্তার্কিককে তাকাতে হবে দর্শকের চোখের দিকে, শরীর থাকবে সোজা। হাত ও মুখের অভিব্যক্তি হতে হবে বক্তব্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। দুঃখের কথা বলতে গিয়ে হাসি আর আনন্দের বিষয়ে কাঁদো কাঁদো ভাব চলবে না। বিতার্কিকের তার চাহনি দিয়েও দর্শক-¯স্রোতা এবং বিচারকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। চোখের ভাষায় আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। যখন যাকে সম্বোধন করা দরকার, ঠিক তখন তার দিকে তাকাতে হবে। ধরা যাক, বিতর্কিক সম্বোধন করছে বিচারককে, কিন্তু তাকিয়ে রইলো মাটির দিকে, তা হবে না।
বিতর্ক কেন বলি?
বিতর্ক বলি আমরা সেই কথাকে, যেখানে যুক্তি থাকে, যুক্তি খণ্ডন থাকে, প্রতিপক্ষের কথা বলার সুযোগ থাকে। একজন ভালো বিতার্কিকের বক্তব্য হয় সহজবোধ্য, তথ্যসমৃদ্ধ, হৃদয়গ্রাহী, যুক্তিগ্রাহ্য এবং সৃজনশীল। ভালো বিতার্কিকের বক্তব্যে থাকে আত্মবিশ্বাস, সততা, তত্ত্ব-তথ্যের ব্যবহার। একজন ভালো বিতার্কিকের মধ্যে নিজস্বতা খুঁজে পাওয়া যায়।
সম্বোধন থাকতে হবে?
সম্বোধন করার যোগ্যতা থাকতে হবে। দলের সদস্যদের মধ্যে যুক্তি, তথ্য ও কাজ ভাগ করে নিতে পারতে হবে। একই কথা সবাই বলবে না। কিন্তু একজনের বক্তব্যের সাথে অন্য জনের বক্তব্যের সম্পর্ক থাকতে হবে। সময়ের মধ্যে বক্তব্য শেষ করতে হবে।
সময়ের মধ্যে বক্তব্য শেষ না হলে নম্বর হারানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। এমনকি দল হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই অবশ্যই সময়ের মধ্যে বক্তব্য শেষ করতে হবে। একান্ত অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হলে মডারেটরের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিতে হবে। তবে সংকেতের সাথে সাথে বিতর্ক শেষ করা বুদ্ধিমানের কাজ।
মোহাম্মদ হানিফ : সহ-সভাপতি, সিকেডিএফ, চাঁদপুর সদর উপজেলা শাখা।