প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
চাঁদপুরে বিতর্ক চর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত
বিতর্ক এই শব্দটি শুনলেই সবাই একটু নড়েচড়ে বসেন। বিতর্ক সেটি আবার কী? আর মফস্বলের মানুষতো এটাকে নিছক বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই ভাবতেন না। একটা সময় রেডিও ও টেলিভিশনে বিতর্ক অনুষ্ঠান প্রচার হতো। তখন শ্রোতারা এটি অন্য অনুষ্ঠানের মতো উপভোগ করতেন না। কারণ বিতর্কে তারা কোনো রসবোধ খুঁজে পেতেন না। তবে কালের পরিক্রমায় এখন শিক্ষিত শ্রেণির কাছে এটি শিল্প, কথা বলার আর্ট বা সংস্কৃতির একটি মাধ্যম হিসেবেই স্থান পেয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে এটি শিক্ষার্থীদের সহপাঠক্রমের অংশ হবে।
|আরো খবর
যাক ওসব কথা বাদ দিয়ে চাঁদপুরে বিতর্ক শিল্পের চর্চা নিয়ে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতাটি হলো--যখনই আমরা বিতর্ক চর্চা শুরু করি তখন কেউ কেউ বলতেন, বিতর্ক, এটা আবার কী? আর যারা শিক্ষিত শ্রেণীর ছিলেন, খুব বেশি বিতর্ক শিল্পকে বুঝতেন তারা বলতেন যে, না এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। যদিও আমি কখনো সরাসরি বিতর্ক মঞ্চে বক্তব্য রাখিনি, কিন্তু চাঁদপুরে বিতর্ক সংগঠক হিসেবে অসংখ্য বিতর্ক উপভোগ করেছি। যাই হোক, বিতর্ক নিয়ে যখন এতো বিতর্ক, বিতর্ক চর্চা কিন্তু কখনোই থেমে থাকেনি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-চাঁদপুরের সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-এর অফিস যখন কালীবাড়ি মোড়ের নূর ম্যানশনে ছিলো তখন আমরা ইয়েস সদস্য হিসেবে সনাক-টিআইবির সাথে জড়িত ছিলাম। তখন সারা বাংলাদেশে মাত্র ৩৪টি সনাক ছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের দুই ধরনের কমিটি ছিলো, একটি হলো সনাক ও অন্যটি ইয়েস। তখনকার সনাক-টিআইবি, চাঁদপুর গঠিত হয়েছিল চাঁদপুরের সুধীজনদের একাংশ নিয়ে। তৎকালীন সনাক সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মনোহর আলী (বর্তমানে প্রয়াত) এবং সনাক সদস্য ছিলেন প্রথিতযশা চিকিৎসক আলহাজ্ব ডাঃ এম.এ. গফুর, ডাঃ মোঃ একিউ রুহুল আমিন, কাজী শাহাদাত, অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মোশারেফ হোসেন, রূপালী চম্পক ও কৃষ্ণা সাহাসহ বিশিষ্টজনরা। তখন টিআইবির আয়োজনে জাতীয়ভাবে বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেখানে চাঁদপুর থেকে ইয়েস সদস্য ওমর ফারুক ফাহিম অংশগ্রহণ করেন। ফাহিম সেখানে অংশগ্রহণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। তিনি সারাদেশের সকল বিতার্কিককে পেছনে ফেলে প্রথম হয়েছিলেন। অনুজপ্রতিম ওমর ফারুক ফাহিমের সেই বিজয় সারাদেশের সাথে চাঁদপুরে আলোচিত বিষয় ছিলো। আর এই ফাহিমের বিতর্কের জয়গানের আলোচনার মাধ্যমেই চাঁদপুরে কীভাবে বিতর্ক চর্চা শুরু করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে থাকেন সনাক-টিআইবির ইয়েস সদস্যরা। তখনকার ইয়েস সদস্যদের মধ্যে ইবনে আজম সাব্বির, হাবিবুর রহমান পাটোয়ারী, এহসান ফারুক ছন্দ, নাঈম হোসেন, উজ্জ্বল হোসাইন, নুরে আলম নয়ন, কেএম মাসুদ, দৌলত হোসেন শান্ত, ইকরাম হোসেন পুতুল, নেয়ামুল হক, বিপ্লব, আছমা আক্তার আঁখি, ওমর ফারুক ফাহিমসহ আরো অনেকেই জড়িত ছিলেন। ইয়েস সদস্যদের মধ্যে আবার দুটি ভাগ ছিলো। এদের কিছু সংখ্যক নিয়ে সনাকের গণনাট্য দল ছিল এবং কিছু সংখ্যককে নিয়ে ইয়েস কার্যক্রম পরিচালিত হতো। মূলত গণনাটক আর ইয়েস সদস্য সকলে ইয়েস সদস্য হিসেবেই পরিচিত ছিলো। ওমর ফারুক ফাহিমের বিতর্কের সাফল্যের কারণে ইবনে আজম সাব্বিরের নেতৃত্বে ইয়েস মিটিংয়ের আলোচনায় চাঁদপুরের বিতর্ক চর্চা এবং বিতর্ক সংগঠন করার প্রস্তাব আসে। যেহেতু টিআইবি একটি স্বতন্ত্র সংগঠন, সেহেতু সনাক-টিআইবির ব্যানারে বিতর্ক চর্চাকে সাংগঠনিক কাঠামো নেয়া যায়নি। কারণ, টিআইবির ব্যানারে কোনো সংগঠন করার এখতিয়ার ছিল না। তাই ইয়েস সদস্যরা চিন্তা করে, যে কোনোভাবেই হোক একটি বিতর্ক সংগঠন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
পরবর্তী ইয়েস মিটিংয়ে বিতর্ক সংগঠন করার বিষয়ে ইয়েস সদস্যরা সবাই আলোচনায় মিলিত হন। সেই সভায় সনাক-টিআইবি কার্যালয়ে সকলের প্রস্তাব ও সম্মতির ভিত্তিতে একটি নাম নির্ধারণ করা হয়। নামটি হচ্ছে চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলন, ইংরেজিতে চাঁদপুর ডিবেট মুভমেন্ট, সংক্ষেপে সিডিএম। ইয়েস সদস্য ইবনে আজম সাব্বির, ওমর ফারুক ফাহিম, আহসান ফারুক ছন্দ, আশিক-বিন-ইকবাল আনন্দ এবং আমিসহ একটি খসড়া কমিটির তালিকাও প্রস্তুত করি। আমি বয়সে সিনিয়র হওয়ায় সকলে আমাকে সভাপতি হওয়ার জন্যে অনুরোধ জানান। কিন্তু আমি দেখেছি যে, আমার দ্বারা বিতর্কের মঞ্চে বিতর্ক করা সম্ভব নয়, তাই বিতর্ক সংগঠক হতে পারবো এটাই আমার জন্যে গর্বের বিষয় ছিল। ইবনে আজম সাব্বিরকে সভাপতি এবং ওমর ফারুক ফাহিমকে সেক্রেটারী করে চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলনের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সভাপতি নির্বাচন করা হয় আমাকে। এভাবেই শুরু হলো চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলনের বিতর্ক চর্চা। বিতর্ক আন্দোলন সৃষ্টির পর থেকেই চাঁদপুর রোটারী ভবনে তখন এটির প্রথম আনুষ্ঠানিকতা হয়। সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা করা হয় প্রয়াত অধ্যাপক মনোহর আলী স্যারকে এবং সাথে উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তৎকালীন সনাক সদস্যদের। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ও চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী শাহাদাত, প্রকৌশলী মোঃ দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মোশারেফ হোসেন, অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার প্রমুখ। প্রথম বিতর্ক কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয় চাঁদপুর রোটারী ভবনে, সেখানে আমাদের সকলের উপস্থিতিতে খুব সুন্দর একটি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
এরপর আর চাঁদপুরে বিতর্ক চর্চার জন্যে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুরু থেকেই চাঁদপুরে বিশিষ্টজনদের নামে বিতর্ক উৎসব করা হতো। এরপর চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলনের আয়োজনে চাঁদপুর ক্লাবে জাতীয় বিতর্ক উৎসব করা হয়। সেখানে জাতীয় বিতর্ক উৎসবের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক রোটাঃ আলহাজ্ব অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশার। আমরা যারা সামনে থেকে বিতর্ক যোদ্ধা হিসেবে কাজ করি, তাদের নেপথ্যে ছিলেন ইকবাল-বিন-বাশার ও শাহিদুর রহমান চৌধুরীর মতো সমাজসেবীরা। তবে বিতর্ক চর্চার প্রসার ও প্রচারের কাজটি খুবই সহজতর হয়েছে শুধুই চাঁদপুর কণ্ঠ ও কাজী শাহাদাতের মতো বিতর্ক-জ্বরে আক্রান্ত মানুষের জন্যে।
বিতর্ক আন্দোলনের শুরুতেই যুক্ত দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ এবং টাইটেল স্পন্সর হিসেবে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সকে সংযুক্ত করা হয়। কয়েক বছর চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে জেলাব্যাপী একসাথে বিতর্ক চর্চা করার পর চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলন তাদের নিজস্ব গণ্ডিতে ফিরে যায়। ঠিক তখনই কাজী শাহাদাত চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে সাথে ছিলেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজন চন্দ্র দে, সাইফুল ইসলাম, আরিফ হোসেনসহ আরো অনেকে।
কাজী শাহাদাত বিতর্কের প্রাণপুরুষ। একটু রেগে গেলেও কাজের বেলায় আসলে তিনিই কাজী। তার কাজে রয়েছে একটি নিজস্বতা। কোনো কাজ সঠিকভাবে না হলে তিনি সেটি কখনোই করেনই না। আর তিনি যে কাজে হাত দেন সেটি অবশ্যই সঠিকভাবে করেই ছাড়েন। চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন শুরু থেকেই যাত্রা করে এ পর্যন্ত চাঁদপুর জেলা সদর ও উপজেলাগুলোতে বিতর্কের প্রচার-প্রসার ও বীজ বপন করে আজ ফলবান বৃক্ষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। যার ফলস্বরূপ প্রতিবছর পাঞ্জেরী-চাঁদপুর বিতর্ক প্রতিযোগিতার মহাযজ্ঞ চলছে। এ পর্যন্ত টানা ১১টি প্রতিযোগিতার সফল সমাপ্তির পর ২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারণে দ্বাদশ পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার আসর হয়নি। সেটি হবে ২০২৩-২৪ বছরে। এ বিতর্কের মহাযজ্ঞে ৮ উপজেলা থেকে বাছাইকৃত বিতার্কিকদের এনে জেলা পর্যায়ে বিতর্কের মূল মঞ্চে ফাইনালে অবতীর্ণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয় প্রান্তিক, অভিযাত্রা, অগ্রযাত্রা, জয়যাত্রা, জয়ধ্বনি ও উল্লাস। এভাবে প্রত্যেক বছরই চাঁদপুরের সব উপজেলাতে বিতর্কের প্রান্তিক পর্ব সম্পন্নের পর বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে যখন ফাইনাল (উল্লাস) পর্বে পৌঁছে, তখন একেবারেই সঠিক দলটি ফাইনালে পৌঁছে। বিতর্কের প্রচার ও প্রসারে চাঁদপুর কণ্ঠ আট উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বিতার্কিক বানিয়েছে। আর এই দীর্ঘ সময়ের সারথী হিসেবে কাজী শাহাদাত তথা বিতর্ক যোদ্ধারা খুঁজে পেয়েছেন বিতর্ক গুরু নামে খ্যাত ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে। তিনি সব্যসাচী লেখক হিসেবে ইতোমধ্যেই সম্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া পেয়েছেন জেলা শিল্পকলা একাডেমী পদকও। সেই পীযূষ কান্তি বড়ুয়া বিতর্কের এমন কোনো স্থান নেই যেটাতে তিনি প্রবেশ করেননি। প্রকাশিত হয়েছে তার অনেক বিতর্ক সম্পর্কিত লেখা ও গ্রন্থ।
চাঁদপুরে চলতি বছরই সেই চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলন (সিডিএম) সম্পন্ন করেছে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ জাতীয় বিতর্ক উৎসব। এটি পুরো জেলায় এখনও সবচে’ বড় বিতর্ক উৎসব। পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলন ও চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশনের এতোগুলো বছর ধরে নিয়মিত বিতর্ক সংক্রান্ত নানা আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার ফলে চাঁদপুর বিতর্ক শিল্পে এতো উর্বর।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন, চাঁদপুর।