প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
কালের নিরিখে আজকের প্রজন্ম হলো অস্থির প্রজন্ম। যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রজন্ম আজ মুকুলে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিকশিত হওয়ার আগেই। অন্তর্চক্ষুতে জ্ঞানের সম্মিলন ঘটার আগেই প্রজন্ম প্রলুব্ধ হয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রঙিন দুনিয়ায়। ফলে জ্ঞান অর্জনের চেয়ে জাহিরের প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। লাইক-কমেন্টের লোভনীয় জগৎ তাকে প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রযুক্তির মায়াবী কুহকের ডাকে প্রজন্ম দিশা হারায় জীবনের পথ থেকে। অথচ তারা হলো জীবনের মানব-কুসুম। উদ্ভিজ্জ কুসুমের সার্থকতা পরিস্ফুটনে। আপন বর্ণ-বিভায় কিংবা মনমাতানো সৌরভে চারদিক মাতিয়ে তোলাতেই তার পূর্ণতা। কিন্তু মানব-কুসুমের পূর্ণতা কেবলমাত্র বেড়ে ওঠায় সীমাবদ্ধ নয়। তার পূর্ণতা মানুষ নামক পদবাচ্যের সার্থকতা প্রতিপন্ন করার মধ্যেই নিহিত।
জীবনের মানস-কুসুম তথা প্রজন্মের সার্থক বিনির্মাণে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা অপরিহার্য। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার এক শুদ্ধতম বাহন হলো বিতর্ক। সংস্কৃতির অন্যান্য ধারায় বিকৃতির যেমন ভয় থাকে, তেমনি থাকে অনুকরণপ্রিয়তার আশ্রয়। এতে করে ব্যক্তির আপন-সত্তা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তখন আর কাউকে তার নিজের পরিচয়ে বড় করা যায় না। বরং বলতে হয় অমুক যেন তমুকের মতো। কিন্তু বিতর্ক চর্চার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে কারো নাম নিয়ে বড় হতে হয় না। ব্যক্তি বরং নিজ পরিচয়েই বড় হয়ে ওঠে। তখন সে নিজেই অন্যের জন্যে উদাহরণ হয়ে উঠে। বিতর্ক আসলে ব্যক্তির উপরিতলকে নির্মাণ করে না। বিতর্ক ব্যক্তিকে তার অন্তরতল হতেই বিনির্মাণ করে দেয়। এই বিনির্মাণ আপৎকালীন নয়, এই বিনির্মাণ সাময়িক নয়, এই বিনির্মাণ নশ্বর জীবনে অবিনশ্বর। এই বিনির্মাণ ঠিক যেন ল্যামার্কের সূত্রের মতোই সঠিক। অর্থাৎ প্রাণীর বাহ্যিক পরিবর্তন স্থায়ী নয় যতক্ষণ তাতে জীনগত পরিবর্তন সাধিত না হয়। বিতর্ক চর্চা ব্যক্তির মনকে শুদ্ধতায় বিনির্মাণ করায় তা স্থায়ী রূপ লাভ করে। ফলে তা প্রতিফলিত হয় ব্যক্তির সামগ্রিক আচার-আচরণে তথা জীবন-যাপনে।
কোন সিনেমা বা নাটক দেখার আগে মানুষকে উদ্বেগে থাকতে হয় তাতে কোনো অসৎ উপাদান আছে কি না তা ভেবে। কোনো বই পাঠের আগে এই ভেবে গলদঘর্ম হয়ে উঠতে হয়, বইতে না আবার কোন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের অবতারণা করা হয়। কিন্তু বিতর্কের ক্ষেত্রে সে উদ্বেগের ছিঁটেফোঁটা থাকে না। বিতর্ক মানেই পরিশুদ্ধ শিল্প, বিতর্ক চর্চা মানেই বিনম্রতায় ঋদ্ধ জীবনপথের পথিক হয়ে ওঠা। বিতর্ক যেমন একটি শিল্প তেমনি একটি বিদ্যাও বটে। কেবল জ্ঞানঋদ্ধ চর্চা নয়, বিতর্ক আসলে সত্যসমৃদ্ধ জীবনবীক্ষণের সুসংহত মাধ্যম। বিতর্ক প্রগতির সাথে সম্পর্কিত, বিতর্ক চেতনার দ্বারা সংবৃত। বিতর্ক জীবনপথে চিন্তাহীন যাত্রার বাতিঘর।
অভিভাবকরা আজ ভেবে অস্থির, প্রজন্মের সুস্থ মানস গঠনের উপায় কী তা ভেবে। সনদ-নির্ভর শিক্ষাকে জীবনমুখী পরিণতি দিতে করণীয় কী তা খুঁজে খুঁজে আজ তারা হয়রান। অথচ বিতর্ক শিল্পের চর্চা তাদের এ সন্ধানের এক যুৎসই জবাব হতে পারে। রিমোট নির্ভর এবং স্মার্ট বাটন-নির্ভর প্রজন্ম কেবলমাত্র বিতর্ক শিল্পের চর্চার মাধ্যমেই মস্তিষ্ক-নির্ভর মানুষে পরিণত হতে পারে। এমনিতেই আজকাল মস্তিষ্কের ব্যবহার কমে যাচ্ছে মানুষের। মানুষের যা ভাবার ছিল তা ভেবে দিচ্ছে যন্ত্র। ফলে গণিতের হিসাব কষতে যেমন ক্যালকুলেটর চাপতে হয় তেমনি কিছু চিন্তা করে লেখার চাপ কমাতে নিতে হয় চ্যাট জিপিটির সাহায্য। জীবনের এতো অগ্রগতির ভিড়ে মানুষ কই, মানুষের আপন মস্তিষ্কের সেই ক্ষুরধার বিভা কই? আগেকার যুগে যে সমস্ত চিন্তাবিদ পাল্টে দিয়েছিলেন বিশ্বের চেহারা তারা বিতর্ককেই করে তুলেছিলেন আত্ম-বিনির্মাণের হাতিয়ার। তারা মেধায় শান বাড়াতে, চিন্তায় প্রাণ ফেরাতে বিতর্কের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আজকের অভিভাবকদের কাঙ্ক্ষিত সেই জীবন-পারদর্শী প্রজন্ম বিনির্মাণে বিতর্ক চর্চাই হচ্ছে সর্বোত্তম সমাধান। বিতর্ক ব্যক্তিকে বিনীত করে, বিতর্ক ব্যক্তিকে বিদ্বান করে, বিতর্ক ব্যক্তিকে বিজ্ঞানী হতেও সাহায্য করে। বিতর্ক চর্চা ব্যক্তিকে ব্যস্ত রাখে। বিতর্ক অলস সময় যেমন কেড়ে নেয়, তেমনি অলস চিন্তাকেও ঝেড়ে ফেলে। একজন বিতার্কিকের মস্তিষ্ক সর্বদা সক্রিয় থাকে উদ্ভাবনী চিন্তার পারঙ্গমতার শক্তিতে।
একজন বিতার্কিকের শিক্ষা ফেলনা নয়। বিতার্কিকের অর্জিত জ্ঞান তুচ্ছ নয়। তার কর্মক্ষেত্রে কিংবা আত্মপথ বিনির্মাণে বিতার্কিকের জ্ঞান কোন না কোন স্তরে তাকে এগিয়ে দিবেই। মানুষ যা শিখে তাকে নিরন্তর চর্চার মধ্যে রাখতে হয়। নচেৎ তা ভুলে যায়। মানব-মস্তিষ্ক চর্চার অভাবে অনেক তথ্য বিলুপ্ত করে ফেলে। কিন্তু একজন বিতার্কিকের তথ্য ও তত্ত্ব ব্যবহারের সু-অভ্যাস তাকে দীর্ঘদিন তা মস্তিষ্কে ধরে রাখার সক্ষমতা দান করে। বিতর্ক প্রজন্মকে সহজ পথে কিংবা চোরাই পথে বড় হতে শেখায় না। যে শিক্ষা আয়াসহীন সে শিক্ষার স্থায়িত্ব কম। যে শিক্ষা শ্রমহীন, সে শিক্ষা সার্থকতাহীনও বটে। তাকে অনেকটা প্যাসিভ ইমিউনাইজেশনের সাথে তুলনা করা যায়। প্যাসিভ ইমিউনাইজেশন যেমন স্বল্পস্থায়ী এবং বাইরে থেকে প্রবিষ্ট করাতে হয়, তেমনি আয়াসহীন, শ্রমহীন শিক্ষাও বোধ নির্মাণ করতে পারে না, আত্মজাগরণের সলতেকে সে উস্কে দিতে পারে না। পক্ষান্তরে বিতর্ক চর্চার মধ্য দিয়ে অর্জিত শিক্ষার ভিত্তি অত্যন্ত দৃঢ়। কেউ চাইলেও তা সহজে ভুলিয়ে দিতে পারে না। বিতর্ক চর্চা মূলত হাতে-কলমে শিক্ষার উচ্চমানের মাধ্যম। এটা রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘ধানগাছ হতে তক্তা’ হওয়ার মতো শিক্ষা নয়। বিতর্ক আসলে অবিরাম জ্ঞান চর্চার এক অভিরাম মাধ্যম।
প্রতিটা যুগের একটি করে আপন আপন বেদনা থাকে। আজকের যুগের বেদনা হলো যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসন থেকে প্রজন্মকে মুক্ত রাখা এবং মুক্ত করা। আজ হাতের মুঠোয় চলে এসেছে রঙিন জগতের উন্মাদনা। এই মেকি উন্মাদনা হতে প্রজন্মকে দূরে রাখার তপস্যাই আজকের যুগ-যন্ত্রণা। এ যুগ-যন্ত্রণাকে জয় করতে হলে আমাদের বিতর্ক শিল্পের চর্চা ও প্রসারে মনোনিবেশ করতে হবে। বিতর্কের মতো শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চাই হতে পারে যুগ-যন্ত্রণাকে জয় করার এক কার্যকর হাতিয়ার। যে অদ্ভুত আঁধার আজ এসেছে আমাদের চারপাশে, তাকে বিদূরিত করতে চাই বিতর্ক-মশালের আলোক-প্রজ্বালন। ভাসা ভাসা জ্ঞানের প্রজন্ম তৈরি না করে গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন দূরদর্শী মানস-কুসুম নির্মাণই হোক আজ আমাদের তপস্যা। এই তপস্যায় বিতর্ক শিল্পের চর্চাই হোক আমাদের আরাধ্য হাতিয়ার।
ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া : সব্যসাচী লেখক; অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমী।