প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
একটি শক্তিশালী উপসংহার বিতর্কের জয় নিশ্চিত করে
বিতর্কেরও যে একটি উপসংহার থাকা উচিত তা অনেকেরই অজানা। পক্ষে বিপক্ষের অধিকাংশ বিতার্কিক নিজস্ব স্ক্রিপ্টে উদাহরণ, উপমা, যুক্তি, তথ্য, তত্ত্ব ঠাঁসা করে ঠাঁই দিতে গিয়ে উপসংহার টানতেই ভুলে যান। সময় নিয়ন্ত্রক যখন চূড়ান্ত ঘণ্টা বাজান তখন তড়িঘড়ি করে ধন্যবাদ মাননীয় মডারেটর, ধন্যবাদ উপস্থিত সবাইকে বলে কোনো রকম মঞ্চ ত্যাগ করাটা প্রকৃত বিতার্কিকের বৈশিষ্ট্য নয়। আবার অনেকে বার বার চূড়ান্ত ঘণ্টা দেয়ার পরও পুনরায় বিতর্কের বিষয় উপস্থাপন করে প্রতিপক্ষকে একমত হতে বলা পর্যন্ত মাইক্রোফোন ছাড়েন না। এতে করে ঐ বিতার্কিকের অর্জিত নম্বরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই বিতর্কে একটি শক্তিশালী উপসংহার ভীষণ প্রয়োজন। সময়জ্ঞান ঠিক রেখে চূড়ান্ত ঘণ্টার অন্তত ৩০ সেকেন্ড আগে থেকে উপসংহার না টানতে পারলে বিতার্কিকের নির্ধারিত সময়ের কথাগুলো অসমাপ্ত থেকে যায়।
‘বিতর্কের উপসংহার কী’ সে সম্পর্কে আগে আলোচনা করা যাক। বিতার্কিক তার ৪-৫ মিনিটের বক্তব্যে কী বললেন, কেন বললেন, কেন প্রতিপক্ষের মতের সাথে তিনি একমত নন, কেন প্রতিপক্ষ তার বিরোধিতার সাথে একমত পোষণ করবেন--এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সারমর্ম আকারে প্রকাশ করাটাই উপসংহার। বিষয়টি যত সুন্দরভাবে গুছিয়ে উপস্থাপন করা যায়, উপসংহার তত বেশি শক্তিশালী হয়।
সাধারণত ১ম বক্তা তার বক্তব্যে সংজ্ঞায়ন করে একটি উদাহরণের মাধ্যমে নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে নতুন যুক্তি প্রদান করে বলার চেষ্টা করেন যে, বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে তার দাবিটি যৌক্তিক। কিন্তু বক্তব্য শেষে একটি উপসংহার না টানলে তিনি যত ভালোই বলুন না কেন বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ধরা যাক একটি বিতর্কের বিষয়, ‘কেবল শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগই পারে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে’--এ বিষয়ের পক্ষ দলের ১ম বক্তা তার বক্তব্য শেষে উপসংহারে বলা উচিত, মাননীয় মডারেটর যেহেতু শিক্ষা প্রতিটি পেশার আঁতুড়ঘর। দেশের টেকসই উন্নয়নে যতটি খাত রয়েছে, প্রতিটি খাত কতটা স্বচ্ছ ও দক্ষভাবে চলবে কি চলবে না তা নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। আর সেই শিক্ষা খাতেই যদি বিনিয়োগের ঘাটতি থাকে তবে শিক্ষাঙ্গনে দক্ষ শিক্ষক আসবে না। স্বাভাবিকভাবেই দক্ষ শিক্ষক না থাকলে দক্ষ পেশাজীবীও গড়ে উঠবে না। এ জন্যেই আমরা বলছি, কেবল শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগই পারে দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে।
একইভাবে যদি বিতর্কের বিষয় হয়, ‘লোভ নয়, অভাবের কারণেই দুর্নীতি বাড়ছে’। এই বিষয়ের বিপক্ষ দলের ১ম বক্তা তার বক্তব্যের শেষাংশে একটি শক্তিশালী উপসংহার টানতেই পারেন। বলা যেতে পারে, প্রতিপক্ষ বন্ধু, আমি আমার বক্তব্যের শুরুতে সংজ্ঞায়নে বলেছি, আবারো বলছি ‘অভাব’ বলতে শুধু অর্থনৈতিক অভাবকেই বুঝায় না। যার মধ্যে নৈতিকতা নেই তার নৈতিকতার অভাব, যার মধ্যে দেশপ্রেম নেই তার দেশপ্রেমের অভাব, যার মধ্যে মূল্যবোধ নেই তার মূল্যবোধের অভাব, যার মধ্যে ধর্মীয় চেতনা নেই তার ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব রয়েছে। আর এই সকল অভাবের সমন্বয় যার মধ্যে আছে সে-ই হয়ে উঠে দুর্নীতিবাজ। এজন্যেই আমরা বলছি, লোভ নয় অভাবের কারণেই দুর্নীতি বাড়ছে।’
এভাবে বিষয়টি পরিষ্কার করলে প্রতিপক্ষের কথা বলার জায়গাটি কমে যায়। এই যে কথা বলার জায়গাটি কমিয়ে ফেলা--এটিই বিতর্কের ফাঁদ। প্রতিপক্ষকে এমন ফাঁদে ফেলতে পারলে জয় নিশ্চিত।
বিতর্কে বহু ২য় বক্তাকে দেখেছি তত্ত্ব ও তথ্য দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। গুরুত্বপূর্ণ সময়ের পুরোটা বিরতিহীন কথা বলে শেষ করে ফেলেন। কিন্তু তথ্যগুলো কেন দিলেন, যুক্তিগুলো উপস্থাপন দ্বারা তিনি প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কী আদায় করতে চান--তা বক্তব্যের শেষাংশেও বলে যান না। আর তা বলে যেতে পারাটাই হলো বিতর্কের উপসংহার।
পক্ষ দলের ২য় বক্তা তত্ত্ব, তথ্য, যুক্তি প্রদান শেষে একটি উপসংহার টানলে তার বক্তব্যের ভিত মজবুত হয়। যেমন : ‘আগামীর বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ’--এই বিষয়ের পক্ষ দলের ২য় বক্তা অতীত ও সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির পরিমাণ তথ্যসূত্র দিয়ে তুলে ধরে উপসংহারে বলতে পারেন, ‘প্রতিপক্ষ বন্ধু, দুর্নীতির ওপর চাইলেই আমরা নিয়ন্ত্রণ আনতে পারি। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সরকারের সদিচ্ছায়, কঠোর আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সুশাসন, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ইতিবাচক ব্যবহার, নৈতিক প্রজন্ম গঠনে নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা চাইলেই নরওয়ে, নিউজিল্যান্ডের মত বাংলাদেশের দুর্নীতিকে ভবিষ্যতে কমিয়ে আনতে পারবো। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ এগুলোর কোনোটির ওপরই নির্ভরশীল নয়। আইনের কঠোর প্রয়োগ দিয়ে, সুশাসন বা সরকারের সদিচ্ছার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থামানো অসম্ভব। তাই নদীমাতৃক বাংলাদেশের আগামীর বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
যদি কোনো একটি বিতর্কের বিষয় হয়, ‘সন্তানের সামগ্রিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকা অধিক।’ তবে বিপক্ষ দলের ২য় বক্তা বেশ মজা করেই বলতে পারেন, ‘মাননীয় মডারেটর, নেপোলিয়ন বলেছিলেন, আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দিবো। প্রতিপক্ষের কাছে আমার প্রশ্ন, যদি মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকাই বেশি হতো তবে কেন নেপোলিয়ন বলেননি, আমাকে একজন শিক্ষিত বাবা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দিবো? মাননীয় মডারেটর, মা মাতৃস্নেহের নৌকা বেয়ে সন্তানকে শৈশবের নদী পার করেন তা আমরা জানি ও মানি। কিন্তু সেই নৌকাটি চালাতে যে জ্বালানি প্রয়োজন তার যোগান দেন একজন বাবা। মা সন্তানকে পড়ার টেবিলে বসান, বাবা পড়ার টেবিলের শিক্ষা উপকরণগুলো যোগান দেন। মা সন্তানকে স্কুল ক্যাম্পসে পৌঁছে দেন, বাবা স্কুল ক্যাম্পাসে টিকে থাকার মাসিক ব্যয় মিটান। বাবা নামক এটিএম বুথটি না থাকলে সন্তানের সামগ্রিক শিক্ষা নিশ্চিত বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে সন্তান ছিটকে পড়ে শিক্ষার স্বাভাবিক স্রোতধারা থেকে। এজন্যেই আমরা বলছি, সন্তানের সামগ্রিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকা অধিক।
একজন দলপ্রধান তার বক্তব্যে উপসংহার টানতেই হবে। তাকে শুধু তার বক্তব্যের নয়, পুরো বিতর্কের উপসংহার টানতে হয়। নিজ দলীয় ১ম বক্তা কী বলেছেন, ২য় বক্তা কী বলেছেন তার চুম্বক অংশ বলে নিজের বক্তব্যের মূলকথা উপস্থাপন করে কেন তিনি বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে এবং কেন প্রতিপক্ষের বক্তব্য ভিত্তিহীন তা উপসংহারের মাধ্যমে পরিষ্কার করা উচিত।
উদাহরণস্বরূপ, আইনের কঠোর প্রয়োগই পারে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে--এ বিষয়ের বিপক্ষ দলের দলপ্রধান উপসংহারে বলতে পারেন, মাননীয় মডারেটর, যেহেতু আজকের বিতর্কে দুর্নীতি প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে, প্রতিকার নয়। তাই আমার দলের ১ম বক্তা সুশিক্ষা ও নৈতিকতার মাধ্যমে কীভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। আমার দলের ২য় বক্তা তত্ত্ব ও তথ্যের আলোকে মূল্যবোধের মাধ্যমে কীভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন এবং আমি দলপ্রধান হিসেবে প্রতিপক্ষের আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি দেশপ্রেম ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তাই আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতেই পারি, শুধুমাত্র, কেবলমাত্র বা একমাত্র আইনের কঠোর প্রয়োগই নয় বরং এর পাশাপাশি সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারই পারে দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করতে। এভাবে পক্ষ-বিপক্ষ দলের দলপ্রধানগণ যে কোনো বিষয়ের উপসংহার টেনে বিতর্কের মূল পর্বের বক্তব্য শেষ করলে বক্তব্যটি পূর্ণতা পায়।
‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’--কথাটির মর্ম যারা বুঝে তারা প্রতিটি কথোপকথন শেষে চমৎকার উপসংহার খোঁজে। উপসংহার ব্যতীত লাগামহীন কথা বলে যাওয়াটা ঘাটে নৌকা বেঁধে সারারাত বৈঠা বেয়ে যাওয়ার শামিল। একজন প্রকৃত বিতার্কিক দশ-বারোটি যুক্তি দিয়ে এমন স্ক্রিপ্ট সাজান না, যে স্ক্রিপ্টের শুরু আছে শেষ নেই। বরং প্রকৃত বিতার্কিকগণ যতটুকু বলেন, ততটুকুর চমৎকার একটি ফিনিশিং টানেন। এই কৌশলগত ফিনিশিংটাই হলো শক্তিশালী উপসংহার। যা বিতর্ক মঞ্চে জয় নিশ্চিত করে বিতার্কিকদের আনন্দের জোয়ারে ভাসায়।
লেখক : উপাধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি; পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় পর পর তিন বছর কলেজ গ্রুপে জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন দলের দলপ্রধান।