প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
ছোটবেলা থেকেই বিতর্ক নামক শিল্পের সাথে আমার পরিচয়। বাবা-মার সাথে বিতর্ক প্রতিযোগিতা দেখতে যেতাম। শুনতাম বিতার্কিকরা কী বলছে। তখন অতটা বুঝতাম না বিতর্ক কী। আমি আর আমার ছোট ভাই খুব আনন্দের সাথে যুক্তি উপস্থাপন দেখতাম। কিছু না বুঝলেও বিতর্ক শুনতে ভালো লাগতো। এভাবেই বিতর্ক করার ইচ্ছা আমার মধ্যে জন্ম নেয়। সেই ইচ্ছা থেকে আমি বিতর্ক একাডেমির বিতর্কের কোর্সটি সম্পন্ন করি। তারপর আমি যখন ৫ম শ্রেণিতে পড়ি, তখন সিকেডিএফ-এর আয়োজনে প্রথম বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম পর্যায়ে আমরা হেরে যাই। কিন্তু সেই হার থেকে অনেক অভিজ্ঞতা, কৌশল অর্জন করে বিতর্কের চর্চা অব্যাহত রাখি। তারপর ২০১৯ সালে পঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় যুক্ত করল প্রথম ইংরেজি ভাষায় সনাতনী বিতর্ক। তখন সনাতনী বিতর্কের তালিম নিয়ে স্কুল থেকে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নাম দেই। আমাদের স্কুলে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় সৈকত অধিকারী স্যার আমাকে ২য় বক্তা রেখে আমাদের দল করলেন। আমাদের দলের দলনেতা ছিলেন রাজিমা আপু এবং ১ম বক্তা হিসেবে ছিলেন সাদিয়া আপু। আমরা স্কুল শেষ করে প্রতিদিন আমার বাসায়, স্কুলে বিতর্কের বিষয় নিয়ে বসতাম। আমার গুরু পীযূষ কান্তি বড়ুয়া ও আমাদের শিক্ষক সৈকত স্যার আমাদেরকে সবরকমভাবে সহযোগিতা করেছেন। তারা আমাদের দলকে ইংরেজি ভাষায় বিতর্ক করায় পারদর্শী করে তোলেন। প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় আমরা জয়লাভ করি। এরপর সকল ধাপ উত্তীর্ণ হয়ে আমরা ফাইনালে পৌঁছাই। প্রত্যেকটি ধাপে ছিলো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। যতই ফাইনালের দিকে এগোচ্ছিলাম মনে তত ভয় লাগছিলো যে আমরা পারবো কি না। তবে আমাদের শিক্ষকরা, আমার গুরু আমাদের সাহস দিয়েছেন এগিয়ে যাওয়ার। আগে দেখতাম আমার গুরুর কাছে অনেক বিতার্কিক আসতো এবং তারা এই ধাপগুলো নিয়ে খুব চিন্তিত থাকতো। তখন বলতাম এগুলো কতো সহজ। কিন্তু যখন আমি নিজে এ পর্যায়ে গেলাম তখন বুঝলাম যে, কেন তারা চিন্তিত ছিলো। তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
আমরা সকল ধাপ পেরিয়ে পৌঁছালাম ফাইনাল পর্বে। ফাইনালের দিন সকালে খুব ভয় পাচ্ছিলাম কী হয়, আমরা পারবো কি না। দলের সবাই সকালে স্কুলে গেলাম এবং এরপর স্কুলের গাড়ি করে শিল্পকলায় গেলাম। অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করার সময় খুব ভয়ও করছিলো, আবার খুব আনন্দও হচ্ছিলো। খুব সুন্দর করে ওইদিন সেজেছিলো শিল্পকলা। মনে সাহস জাগে এবং মনে হয় যে আমি পারবো, আমরা পারবো। রাজিমা আপু আর সাদিয়া আপু আমাকে ভরসা দিচ্ছিল যে আমরা পারবো। ২টি বিতর্ক হওয়ার পর শুরু হলো আমাদের বিতর্ক। আমরা স্টেজে উঠলাম এবং যার যার আসনে বসলাম। আমাদের প্রতিপক্ষ ছিলো সরকারি মহিলা কলেজ। তারাও খুব তুখোড় বিতার্কিক ছিলো। ফাইনালে আমি ১ম বক্তা হিসেবে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। একে একে সবাই তাদের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করলো। শেষ হলো আমাদের বিতর্ক। বিতর্ক শেষে আমরা আরো বিতর্ক শুনলাম।
অবশেষে এলো ফলাফল ঘোষণার পালা। ঘোষণা হতে লাগলো বিতর্কের ফলাফল। বিকেলের সেশনে আমাদের স্কুলের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই এসেছিলো। সকলে অপক্ষায় ছিলো আমাদের রেজাল্টের জন্যে। আমার মা ও ছোট ভাই সকাল থেকে আমার সাথে ছিলো এবং তারাও খুব চিন্তিত ছিলো। ঘোষণা হলো শ্রেষ্ঠ বক্তার নাম। শ্রেষ্ঠ বক্তা হলেন আমাদের দলের দলনেতা রাজিমা আপু। স্কুলের সবাই আনন্দিত হলো। এখন পুরো হল চুপ হয়ে গেল। রাজন আংকেল বিজয়ী দলের নাম প্রকাশ করতে গিয়ে থেমে যাচ্ছেন। এতে আমরা আরো চিন্তিত হয়ে পরলাম। আমার হাত ঠাণ্ডা হতে লাগলো। খুব ভয়। কী হয়! তারপর হঠাৎ করে ঘোষণা হলো ‘ইংরেজি বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’। এটা বলার সাথে সাথে স্কুলের সবাই জোড়া হাতে তালি দিলো। শিক্ষকরা আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মা আমাকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। অভিনন্দন জানালো। রাজিমা আপু, মা, সবাই কান্না করতে লাগলো। তখন বুঝলাম যে, এ জয় শুধু আমার কিংবা আমার দলের না, এ বিজয় আমাদের স্কুলের, আমাদের মায়ের, আমার গুরুর। এবং আমি এটাও শিখলাম যে, বিতর্কে যুক্তি উপস্থাপন আর দলের সকলের একত্রে কাজ করাই আসল। আমরা দলের সবাই যদি ঠিক মতো নিজেদের যুক্তিতর্ক সমন্বয় করে উপস্থাপন না করতাম, তবে আমাদের পক্ষে এ জয় ছিলো অসম্ভব। আমাদের এ জয়ের কৃতিত্ব আমাদের শিক্ষকদের। আমি কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধা জানাই আমার বিতর্কগুরু ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে। যিনি আমাকে বিতর্কের জন্যে তৈরি করেছেন। ধন্যবাদ জানাই আমার মা মুক্তা পীযূষ কে, যিনি আমাকে প্রেরণা দিয়েছেন, আমাদের দলের জন্যে দিনরাত কষ্ট করেছেন। সবশেষে বিতর্ক আমাকে সবচেয়ে মূল্যবান একটি শিক্ষা দিয়েছে : ‘যে আসে বিতর্কে, সে হারে না’।