প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, যুক্তিনির্ভর, যুক্তিমনস্ক, সৃষ্টিশীল মানুষ হওয়া ও মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে বিতর্ক চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একেকজন বিতার্কিক মানে একেকটি নক্ষত্র। একটি স্বপ্নের সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি রয়েছে একেকজন তরুণ বিতার্কিকেরও। বিতর্ক চর্চা হলো প্রকৃত জ্ঞানার্জনের একটি সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। বিতর্ক চর্চার ফলে তরণদের মেধা বিকাশের পাশাপাশি একটি সৃজনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। চাঁদপুর জেলার প্রতিটি উপজেলায় শিক্ষার্থীদের সহপাঠক্রমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে এবং শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশকে আরো প্রস্ফুটিত করার মহান ব্রত নিয়ে আজ থেকে ১৪ বছর পূর্বে চাঁদপুর কণ্ঠ ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স জেলাব্যাপী বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু করে।
এই প্রতিযোগিতাটি ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয়ে চাঁদপুরের মাটিতে বিরামহীনভাবে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে পরিচালিত হয়। ২০২০ সালে ছিলো প্রতিযোগিতার এক যুগপূর্তি। আমরা এই যুগপূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে নভেম্বর ২০১৯ থেকেই বিভিন্ন প্রস্তুতি শুরু করি। যুগপূর্তিকে কীভাবে প্রাণবন্ত করা যায় সেই প্রয়াসেই আমরা ধাপে ধাপে সভা আহ্বান করি। সভায় আয়োজনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়াও চাঁদপুরে বিতর্কের পথিকৃৎ শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত কর্তৃক ১১তম আসরের সেমি-ফাইনাল পর্বের ঘোষণা অনুযায়ী পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার এক যুগপূর্তিতে সংসদীয় ধারায় ৮টি বিতর্ক দল অংশগ্রহণ করার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। সেই মোতাবেক এক যুগপূর্তি উপলক্ষে সনাতনী ধারায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও ইংরেজি পর্যায়ে এবং সংসদীয় ধারাসহ মোট ১৫০টি বিতর্ক দলের অংশগ্রহণে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
আমার অত্যন্ত আপনজন চাঁদপুরে বিতর্কের প্রাণ পুরুষ চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ)-এর সভাপতি ও চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার টাইটেল স্পন্সর দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের কর্ণধার শ্রদ্ধেয় কামরুল হাসান শায়কের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ফাইনালের তারিখসহ উপজেলা ভিত্তিক ও জেলা পর্যায়ের প্রতিটি পর্বের তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন। ১৯ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রান্তিক পর্ব হাজীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়ার কথা ছিলো। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ২০ মার্চ ২০২০ হাইমচর, ২১ মার্চ ২০২০ মতলব দক্ষিণ, ২৮ মার্চ ২০২০ ফরিদগঞ্জ, ৩০ মার্চ ২০২০ মতলব উত্তর, ০২, ০৩, ০৪ ও ০৫ এপ্রিল ২০২০ চাঁদপুর সদর, ১১ এপ্রিল ২০২০ কচুয়া এবং ১২ এপ্রিল ২০২০ শাহরাস্তি পর্ব আয়োজন করার জন্য তারিখ নির্ধারণ করে সিকেডিএফ-এর প্রতিটি উপজেলা কমিটিকে অবহিত করা হয়।
ফেব্রুয়ারি ২০২০ মাসের শেষ দিকে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স-এর বরাবরে প্রতিযোগিতার প্রোফাইল জমা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৫ মার্চ ২০২০ তারিখের মধ্যে প্রতিযোগিতার চাহিদা মোতাবেক পাঞ্জেরী কর্তৃপক্ষ চাঁদপুর কণ্ঠ বরাবরে সকল উপকরণ পাঠিয়ে দেয়। উপকরণ হাতে পাওয়ার পর আমরা অর্থাৎ সিকেডিএফ সভাপতি কাজী শাহাদাত, যুগ্ম সম্পাদক রবিউল আউয়াল, সদর উপজেলা সিকেডিএফের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবু সালেহ, সদস্য সোহাঈদ খান জিয়া ও আমি উপজেলা ভিত্তিক উপকরণসমূহ গুছিয়ে রাখি। এমনকি কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চিঠিও পৌঁছানো হয়। এছাড়াও ভেন্যু, বিচারক প্যানেল, মডারেটর প্যানেল, বিতর্কায়ন, ব্যানার, সাউন্ড, গাড়িসহ অন্যান্য উপকরণ এমনকি জেলা থেকে কে কোন্ দিন কোন্ উপজেলায় যাবেন তাও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আঘাত হানার পর ০৮ মার্চ ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তারপর ১৬ মার্চ ২০২০ তারিখে সরকার ২২ মার্চ ২০২০ থেকে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধসহ চলমান সকল পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, কোভিড-১৯ স্বাভাবিক পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো না খোলা পর্যন্ত পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা স্থগিত থাকবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিতার্কিক ও শিক্ষকবৃন্দ আমাদের সাথে যুগপূর্তির প্রতিযোগিতা আয়োজন বিষয়ে যোগাযোগ করেন এবং আমাদের খোঁজ খবর নেন। আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি এই করোনাকালীন সংকটেও তারা আমাদেরকে মনে রাখার জন্যে। তারা বিতর্ককে এবং আমাদের আয়োজনকে কতোটা ভালোবাসলে এভাবে এই সংকটময় মুহূর্তেও খোঁজ খবর নিতে পারেন সেটি ভেবে সশ্রদ্ধ সালাম ও অভিনন্দন তাদের প্রতি।
করোনা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। যে কারণে সরকার ৬ আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। চাঁদপুরেও এর ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং প্রতিটি উপজেলায় প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন ইত্যাদি কারণে ততক্ষণে কর্মহীন ও উপার্জনহীন হয়ে পড়ে অনেক পরিবার। দেখা দেয় খাদ্য ও মানবিক সঙ্কট। এ সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের ক্রান্তিকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলা পর্যন্ত আমরা যুগপূর্তি প্রতিযোগিতা আয়োজন আর করতে পারি নি। অনেকেই আমাদেরকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সীমিত আকারে প্রতিযোগিতা আয়োজন করার কথা বলেন। ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাদেরকে, যারা বিতর্ককে ও আমাদের আয়োজনকে ভালোবেসে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা ভেবে দেখেছি, ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আয়োজন করা হলে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে না।
১৫ বছর পূর্বে যখন একটি প্লাটফর্ম আকারে চাঁদপুরে পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন থেকেই আমি বিতর্কের সাথে যুক্ত হই। তারপর অদ্যাবধি যুক্ত আছি। আমি মনে করি, পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজনের কারণে চাঁদপুর থেকে শত শত বিতার্কিক সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি দেশসেরা বিতার্কিক সৃষ্টি হয়েছে। অবশেষে আমরা তিন বছর বিরতিতে পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার এক যুগপূর্তি আয়োজন করতে যাচ্ছি। বলা বাহুল্য, সৃজনশীল এ আয়োজন সমগ্র চাঁদপুর জেলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তরুণদের মাঝে। এটি এত দ্রুত চাঁদপুরের তরুণদের হৃদয়ে গেঁথে যাবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। বলা যায়, চাঁদপুর এখন বিতর্ক শিল্পী নির্মাণের কারখানা। বহু প্রতিশ্রুতিশীল বিতার্কিক সৃষ্টি হয়েছে এ মাটিতে। আর সেই সৃষ্টির মূলে যে চারটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন রয়েছে তাদের নাম না লিখলে অকৃতজ্ঞ থেকে যাবো। নিঃসন্দেহে প্রথমেই রয়েছে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ, তারপর দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিঃ, চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলন (সিডিএম) ও সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত চাঁদপুরের একমাত্র বিতর্ক সংগঠন চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ)।
চাঁদপুরে বিতর্কের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে সে আন্দোলনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক এই প্রত্যাশা করছি। পরিশেষে যে বা যারা দীর্ঘ ১৫টি বছর যাবত আমাদের এই আন্দোলনের সাথে ছিলেন এবং আছেন, এমনকি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের সবাইকে চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ)-এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। চাঁদপুরে বিতর্কের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য সকলের একান্ত সহযোগিতা কামনা করি। বিতর্কের জয় হোক।
রাজন চন্দ্র দে : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ), চাঁদপুর।