প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
![বিতর্কের জয়ধ্বনি ফের শোনার প্রতীক্ষা](/assets/news_photos/2023/07/16/image-35449.jpg)
যুক্তি জানা মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে হয় না, যুক্তিই মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। কথাটি প্রতিজন বিতর্ক শিল্পী জানেন ও মানেন। যার মেধার ডিকশনারিতে যত বেশি যৌক্তিক শব্দ থাকবে, নিঃসন্দেহে সে বাস্তব জীবনে তত বেশি এগিয়ে যাবে। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মেধায়-মননে সেই যৌক্তিক শব্দের বুনন করে যাচ্ছিলো যেসব প্রতিষ্ঠান, সেগুলো হলো : দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। ‘পাঞ্জরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা’ শধু একটি প্রতিযোগিতার নামই নয়, এ আয়োজন হাজারো শিক্ষার্থীকে যৌক্তিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। ২০২০ সালের মার্চ মাসে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যখন বন্ধ হয়ে যায় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তখন সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও শুরু হয়নি বিতর্কের যুগপূর্তি আয়োজনটি। তাই ২০১৯ সালে সর্বশেষ বিতর্ক সম্পন্ন হওয়ার পর গত চার বছর বন্ধ থাকা সেই বিতর্কটি ফের শুরু হচ্ছে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে। প্রতিজন বিতার্কিকের জন্যে সংবাদটি নিঃসন্দেহে স্বস্তির ও আনন্দের।
এই স্বস্তির সংবাদের মধ্যে দুঃসংবাদ হলো এই যে, গত চার বছরে চারটি ব্যাচ বিতর্ক চর্চা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০১৯ সালে যারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস সিক্সে ছিলো তাদের মধ্যে অনেকেই তৎকালীন বড় ভাইয়া-আপুদের বিতর্ক দেখে হয়তো ভেবেছিলো, বড় হয়ে তারাও হয়ে উঠবে একজন আদর্শ বিতার্কিক। কিন্তু তা আর হলো কই? বিতার্কিক তৈরির কারখানা যেখানে বন্ধ, সেখানে বিতার্কিক তৈরি হওয়াটা কষ্টেরই ছিলো। চার বছর আগে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীরা এখন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অক্টোবর মাসে তাদের টেস্ট পরীক্ষা, ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি। তাই তাদের আর বিতর্কে অংশগ্রহণ করার সুযােগ দেখছি না। ২০১৯ সালে শেষ বিতর্ক চলাকালীন যারা ৭ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ছিলো তাদের সিংহভাগ বিতর্ক শিল্প চর্চা ছাড়াই পাড়ি দিয়েছে মাধ্যমিক গণ্ডি। বিতর্ক চর্চাহীন মাধ্যমিক গণ্ডি পাড়ি দেয়াটা আপাত দৃষ্টিতে তেমন কোনো ক্ষতির কারণ মনে না হলেও এই শিক্ষার্থীরাই এইচএসসি দিয়ে যখন ভার্সিটিতে যাবে, ভার্সিটির প্রতিটি প্রেজেন্টেশনে যখন জড়তায় ভুগবে তখন তাদের মনে হবে জেলা বিতর্কের চার বছরের এই শূন্যতার কথা। মনের অজান্তেই সেদিন বিতর্ক চর্চা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা বলে উঠবে, ইস! আমাদের স্কুল লাইফেও যদি পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক আয়োজনটি হতো!
অতীতে যারা বিতর্ক চর্চা করেছেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন তারা সকলেই এখন এক-একজন পরিপূর্ণ বাচিক শিল্পী। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১১টি আসরে প্রাথমিকের যে শিক্ষার্থী বিতর্ক করেছে মাধ্যমিকে সে এখন অনর্গল কথা বলছে। মাইক্রোফোন, স্টেজ, বক্তৃতা, তার কাছে জড়তাহীন, ভয়হীন একটি কাজ। মাধ্যমিকে যারা বিতর্ক করেছে, নামের আগে বিতার্কিক শব্দটি বসেছে তারা এখন কলেজে গিয়ে কথার খই ফোটাচ্ছে। ভার্সিটিতে যারা বিতর্ক করেছে তারা প্রায় সকলেই এখন কোনো না কোনো বিতর্কের বিচারক বা বিতর্ক সংগঠক হিসেবে কাজ করছে। কারণ বিতর্ক এমন একটি সৃজনশীল শিল্প, যা যতই চর্চা করা হয় ততই মেধাকে শাণিত করে। গ্রাম বাংলায় একটি কথা আছে ‘বলতে বলতে বক্তা, বাটতে বাটতে ভর্তা’। বিতর্ক চর্চাটি তেমনই। পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বৃহৎ আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জড়তা ও ভয় দূর করার কাজটি করছে অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে। উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, বক্তব্যে শব্দ নির্বাচন, মাইক্রোফোনের ব্যবহার, বিশেষ ক্ষেত্রে উপমা বা উদাহরণ কেমন হতে পারে তা ধরিয়ে দিচ্ছেন সম্মানিত বিচারকগণ। এই মহৎ কাজটির মাধ্যমে কত শত বক্তা যে ১১ বছরে তৈরি হয়েছে তা সম্পর্কে ধারণা নেই অনেকেরই।
আজকে ঢাকার কোনো ভার্সিটির অনুষ্ঠানে বা মিলনায়তনে অথবা প্রশাসনিক অনুষ্ঠানে যদি কোনো শিক্ষার্থী মঞ্চ কাঁপানো বক্তব্য দেয় আর তার বাড়ি হয় চাঁদপুর, তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে পাঞ্জরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার কোনো এক সময়ের বিতার্কিক ছিলো। এ অর্জন নির্দ্বিধায় চাঁদপুর কণ্ঠের। এ অর্জনের গর্জন তোলার সময় হয়েছে আজ। যুগপূর্তি উৎসবে সে গর্জন তুলুক প্রতিজন বিতর্ক শ্রমিক, যাদের নিরলস শ্রমে সিকেডিএফ-এর ব্যবস্থাপনায় পাঞ্জরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক আয়োজনটি আজ পাড়ি দিতে যাচ্ছে এক যুগ। বিতর্কের এক যুগপূর্তিতে, মাতুক সবাই ফূর্তিতে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের প্রাণবন্ত বিতর্ক শেষে বিতার্কিক, বিতর্ক শ্রমিক, বিতর্ক বিষয়ক শিক্ষক, অভিভাবক ও শ্রোতাদের জয়ধ্বনি ফের শোনার প্রতীক্ষায় আছি। মহামারীর প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে প্রাণের বিতর্ক শুরু হোক, জয়-পরাজয় যা-ই আসুক, দিনশেষে বিতর্কের জয় হোক।
রাসেল হাসান : কলেজ পর্যায়ে টানা তিনবার জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন দলের বিতার্কিক; শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে বহুবার পুরস্কৃত, বিতর্ক সংগঠক, বিতর্ক প্রশিক্ষক ও বিচারক।