শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

সংগীতে চাঁদপুরের পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করে দিয়ে যেতে হবে
সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক ॥

২০ থেকে ৩০ বছরব্যাপী একটি প্রজন্ম। এ সময়টাতে কারো দ্বারা সৃষ্ট ভালো কিছুর ধারাবাহিকতা যদি কেউ পরবর্তী প্রজন্মে নিয়ে যাবার মতো উপযুক্ত লোক তৈরি করে দিয়ে যেতে পারেন, তাহলেই তিনি অনেক সার্থক। আর এটা না করতে পারলে তার সার্থকতায় কিছু ঘাটতি থেকে যায়। চাঁদপুরের সংগীত অঙ্গনে এমন ঘাটতি যাতে প্রথিতযশা কোনো শিল্পীর না থাকে সেজন্যে কম-বেশি উদগ্রীব প্রবীণ কণ্ঠশিল্পী ইতু চক্রবর্ত্তী। সেজন্যে তিনি তাঁর ছোটবোনতুল্য চাঁদপুরের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রূপালী চম্পককে প্রায়শই বলেন, চাঁদপুরের সংগীত অঙ্গনে পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করে দিয়ে যেতে হবে। গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠের 'সংস্কৃতি অঙ্গনে'র সাথে মুঠোফোনে সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতায় ইতু চক্রবর্ত্তী এ কথা বলেন।

'পরবর্তী প্রজন্ম তৈরির এমন তাগিদ কেন' জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সেজদি বাচ্চু চক্রবর্তী স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে চাঁদপুরের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। গেল মার্চের ৩ তারিখে তিনি কলকাতায় মারা গেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আঃ জব্বার, আপেল মাহমুদ, আবিদা সুলতানা সহ একদল শিল্পী চাঁদপুরে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে গান গাইতে। তাঁদের সে অনুষ্ঠানে চাঁদপুরের একমাত্র শিল্পী হিসেবে সেজদি (বাচ্চু চক্রবর্তী) গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি যখন গানে টান দেন, শ্রোতামাত্রই অশ্রুজলে সিক্ত হয়েছেন। পুরো গান শুনে আঃ জব্বার ও তাঁর সহশিল্পীরা বলেন, আপনার মতো ভালো শিল্পী চাঁদপুরে পড়ে আছেন কেন? সেই সেজদি ভারত চলে যাবার পর আমি, সেজদির ছাত্রী রূপালী ও কৃষ্ণা সাহা সহ আরো ক'জন চাঁদপুরের সংগীত ভুবনকে ভালোই ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু বার্ধক্য ও অসুস্থতা আমার সংগীত চর্চার গতিশীলতা কম-বেশি ব্যাহত করেছে। কৃষ্ণা সাহাও সংগীত চর্চায় আগের মতো সক্রিয় নয়। আমাদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে সক্রিয় হচ্ছে রূপালী। সেজন্যে তাকে পরবর্তী প্রজন্ম তৈরির তাগিদ দিয়েছি। সে পারিবারিক আনুকূল্যে গানের স্কুল চালায়, নিয়মিত সংগীত চর্চা করে। আশা করি সে কাঙ্ক্ষিত সংগীত-প্রজন্ম তৈরি করে দিয়ে যেতে পারবে।

নিজের সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমেই সুখস্মৃতি তুলে ধরেন ইতু চক্রবর্ত্তী। স্বাধীনতার পর ভারতের হাওড়া জেলার এক সংগীত প্রতিযোগিতায় নজরুল সংগীতে তিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন। যে কঠিন প্রতিযোগিতায় কবি নজরুলের সাথে গানের স্বরলিপি লেখা বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জগৎ ঘটক ও আরেক ব্যক্তিত্ব অনল চট্টোপাধ্যায় বিচারক হিসেবে ছিলেন। গান শুনে জগৎ ঘটক ইতু চক্রবর্ত্তীকে বলেছিলেন, নজরুল সংগীত চর্চা চালিয়ে যেও মা।

চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনে হালে নাম মুছে যেতে বসা সংগীত প্রতিষ্ঠান ললিত কলার নামকরা শিল্পীই হচ্ছেন ইতু চক্রবর্ত্তী। তাঁরা মূলত বিক্রমপুরের আদি বাসিন্দা। দাদা প্রফুল্ল চন্দ্র চক্রবর্ত্তী ছিলেন পেশকার। পেশাগত কারণে চাঁদপুরে দীর্ঘদিন অবস্থানের কারণে শহরের গুয়াখোলায় জায়গা কিনে বাড়ি করেন। তাঁর বাবা নগেশ চক্রবর্ত্তী পড়ালেখাশেষে পাকিস্তান আমলে হাবিব ব্যাংকে চাকুরি নেন। ব্যাংক বন্ধ হবার কারণে বেকারত্বের শিকার হয়ে পুরাণবাজারে এক গদিতে 'সরকার' হিসেবে চাকুরি নেন। কিন্তু সাত মেয়ের সংসারে অভাব-অনটন পুরোপুরি গোছাতে পারেন নি। তিনি ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। ঢাকার ওয়ারী ক্লাবের হয়ে খেলতেন। নাটক করতেন। নাটক করে আটআনা ওজনের গোল্ড মেডেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ভালো গান গাইতেন। তবে একটি হারমোনিয়াম কেনার সামর্থ্য তাঁর ছিলো না। তিনি খালি গলায় গাইতেন, আর মেয়ে ইতুকেও শেখাতেন মুখে মুখেই। সেই মেয়ে ইতু চক্রবর্ত্তীই কালক্রমে চাঁদপুরের সংগীত অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে চাঁদপুরের উল্লেখযোগ্য সংগীতানুষ্ঠান সমূহের অনিবার্য অংশে পরিণত হন।

'সাম্প্রতিক সময়ে গান গাইছেন না কেন' এমন প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, না, গান ছাড়িনি। সমবেত কণ্ঠে তো স্টেজে থাকি। একক সংগীত গাই না সাম্প্রতিক কাশের সমস্যার কারণে। সমস্যাটা কেটে গেলে একক গান অবশ্যই গাইবো।

ইতু চক্রবর্ত্তীর বাবা মারা গেছেন ১৯৯০ সালের ১৪ জুন। তাঁদের ৭ বোনের মধ্যে তিনি ও কলি চক্রবর্ত্তী (ভারত প্রবাসী) নামের আরেক বোন অর্থাৎ ২ বোন বেঁচে আছেন। 'আপনি কোথায় থাকেন' জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আমাদের বাবার বাড়িটি দুঃখজনকভাবেই হারিয়েছি। বাবার অনুপস্থিতিতে প্রতিবেশী ভ্রাতৃতুল্য কমল মজুমদারের দেখভালেই থেকেছি এবং বাড়ি হারিয়ে তার বাসাতেই উঠেছি। কিন্তু তিনিও হঠাৎ গত ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে অকালে হারিয়ে গেলেন।

ইতু চক্রবর্ত্তী চাঁদপুর শহরের গণি মডেল হাই স্কুলে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান এবং পরবর্তীতে কোড়ালিয়ায় অ্যাডভোকেট ফজলুল হক সরকারের বাড়িতে অবস্থিত নবারুণ শিশু বিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যক্ষ। এ বিদ্যালয়ে গানের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরবর্তীতে তাঁর দক্ষতা দেখে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি তাঁকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন।

ইতু চক্রবর্ত্তীর জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পড়ালেখা চাঁদপুরেই। তিনি চাঁদপুর মহিলা কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে যে গুয়াখোলায়, বর্তমান বার্ধক্যও কাটছে সেখানেই। তবে পিতৃগৃহে নয়, আত্মীয়ের চেয়েও বড়ো প্রিয় আপনজনদের সান্নিধ্যে। পরিবারের সবাই স্মৃতিধন্য গুয়াখোলা মানে চাঁদপুর নানাভাবে ছেড়ে গেলেও তিনি ছাড়েন নি। তিনি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের কাদা-জলে, দুঃখ-সুখে নিজের সকল কষ্টকে লুকিয়ে রেখে চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক কিছুর সাক্ষী হয়েই বেঁচে আছেন। তিনি আরো অনেকদিন সুস্থতার সাথে বেঁচে থাকুন--এটাই তাঁর গানের ভক্ত-শ্রোতাদের হার্দিক প্রত্যাশা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়