প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনের এক সময়ের অভিভাবক জীবন কানাই চক্রবর্তী জীবন সায়াহ্নে
কালেভদ্রে দেখা মিলে না বর্তমান সংস্কৃতি অঙ্গনের শীর্ষ নেতৃত্বের কারো সাথে ॥ অপেক্ষার প্রহরে শুধু অপেক্ষাই থাকে, কিন্তু মিলে না কারো সঙ্গ
এক সময়ে চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনের দিকপাল বা অভিভাবক যাঁকে বলা হতো, যাঁর নেতৃত্বে চলতো চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গন, যাঁর নেতৃত্বে বিকশিত হয়েছে চাঁদপুরের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গন, সেই নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি জীবন সায়াহ্নে এসে শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণছেন এক সময়কার সহকর্মী বা সহযোদ্ধা বা অনুজপ্রতিম কারো সঙ্গ পাওয়ার। কিন্তু নির্মমতার করাল গ্রাসে হয়তো হারিয়ে গেছে এককালের সহকর্মী, সহযোদ্ধা বা অনুজ প্রতিমদের সেই মনমানসিকতার, যে মনমানসিকতা দিয়ে অগ্রজের কাছে গিয়ে কিছুটা সময় দিয়ে তাকে মানসিকভাবে সাহস জোগানের কাজটুকু করা যায়।
জন্ম হলে মৃত্যু হবে সেটি যেমন চিরন্তন সত্য, আবার কার মৃত্যু কখন কীভাবে হবে সেটিও লেখা থাকে না। কোনো মানুষ জন্মের পর ধীরে ধীরে তার কৈশোর যৌবন পেরিয়ে যখন বার্ধক্যে পৌঁছে, তখন ক্রমান্বয়ে বয়সের শেষ প্রান্তে চলে যান। বয়সের শেষ প্রান্তে চলে যাওয়ার মানে জীবনের শেষ প্রান্তে চলে যাওয়া। আর সেই প্রান্তিক সময়টাতে প্রতিটি মানুষ তার জীবনের শুরু থেকে যাদের সাথে তার চলাফেরা, উঠাবসা বা জীবন কাটানো হয়েছে, সেই মানুষদের সঙ্গ চায়। কিন্তু এই সমাজ ব্যবস্থায় নানা কারণে সেই সময়টুকু দিতে পারার রেওয়াজ বা প্রবণতা দেখা যায় না বললেই চলে।
চাঁদপুরের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সহ সকল ক্ষেত্রে যাঁর একসময় ছিলো গুরুত্বপূর্ণ বিচরণ, সেই শ্রদ্ধেয় জ্যেষ্ঠ নাগরিক জীবন কানাই চক্রবর্তী ৮৬ বছরে পদার্পণ করেছেন। বয়সের ভারে নানাবিধ রোগে তিনি আজ জর্জরিত। তারপরও কাউকে চিনেন না--এমন অবস্থায় নেই। দেখামাত্রই বলে দিতে পারেন তাঁর সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটির নাম। সেই পূর্বের ন্যায় জানতে চান সব কিছু। কিন্তু বয়স আর রোগ বলে একটি কথা রয়েছে। ইচ্ছে থাকলেও সব কিছু জানতে চাইলেও জানতে পারছেন না। একজনকে দেখলে সামান্য একটা সময় তাকে নিয়ে কিছু বলতে চান এবং কিছুটা আনন্দ বোধ করেন। কিন্তু কিছু সময় পর তাঁর মনটা অগোছালো হয়ে যায়। তারপর আবার ফিরে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিধিবাম, সম্ভব হয় না ফিরে আসাটা। এভাবেই চলছেন ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ থেকে আজ অবধি।
পরিবার থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করেও সেই সময়কার জীবনে তাঁকে ফেরানো যায়নি। যা শুধু তাঁর ক্ষেত্রে নয়, প্রতিটি মানুষের বার্ধ্যকের সময়কালে সক্ষম পরিবারগুলোও নানা চেষ্টা করেও তাতে সফল হতে পারে না।
শ্রদ্ধেয় জীবন কানাই চক্রবর্তীর পরিবারের সাথে আলাপ করে জানা যায়, চিকিৎসকগণ জানিয়েছেন, তাঁকে দিনের কিছু সময় এবং সন্ধ্যার পর কিছু সময় পরিচিতজন বা তিনি যাদের চিনেন জানেন বা যাদের সাথে তাঁর দীর্ঘ চলাফেরা ছিলো এমন লোকদের সাথে কথাবার্তা অথবা তাদের সামনে গিয়ে কিছুটা সময় ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এতে কিছুটা হলেও অবস্থার উন্নতি হতো। তাই চিকিৎসকদের কথা অনুযায়ী পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দীর্ঘ দিনের সতীর্থ বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের জানানো হয়। কেউ সে বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। অবশ্য এ নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আক্ষেপ সরাসরি করা না হলেও মনে রয়েছে অনেক কষ্ট। তাই তো অনেকে বলে থাকেন যে, চাঁদপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনের এক সময়ের বিশাল অভিভাবক আজ জীবন সায়াহ্নে পড়ে থাকলেও এই অঙ্গনের প্রায় সকলে তাঁর কাছ থেকে অনেকটা মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মতোই রয়েছেন।
চাঁদপুরের বিশাল সংস্কৃতি পরিবার, যার রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, এই সংস্কৃতি পরিবার এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করবেন--এমনটাই প্রত্যাশা করছেন বর্তমান প্রজন্ম। যার ফলে পূর্বসূরিদের দেখানো পথ ধরে চলতে পারবে আগামীর সংস্কৃতি অঙ্গন।
উল্লেখ্য, জীবন কানাই চক্রবর্তী ১৯৩৮ সালের পয়লা জুলাই চাঁদপুর সদর উপজেলার শেখেরহাট গ্রামের সম্ভ্রান্ত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চাঁদপুর শহরের কদমতলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষাশেষে ঐতিহ্যবাহী ডিএন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে চাঁদপুর কলেজে ভর্তি হন এবং ছাত্রজীবনে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯৫২ সালে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলন' থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি শেষে ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ছাত্র আন্দোলন থেকে ন্যাপের রাজনীতি পর্যন্ত দেশ ও জনগণের স্বার্থে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে বেশ ক'বার জেল খাটেন। তিনি চাঁদপুর পৌরসভা নির্বাচনে জনগণের সরাসরি ভোটে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
জীবন কানাই চক্রবর্তী প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণকালীন সময়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন। প্রাথমিকে পড়াবস্থায় আবৃত্তি ও রচনা প্রতিযোগিতায় তৎকালীন সময়ে জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার লাভ করেন। তিনি অষ্টম শ্রেণীতে পড়াবস্থায় নাট্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের আগেও সে সময় তিনি শিল্পীদের সমন্বয় করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক, বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী গান পরিবেশন করাতেন।
জীবন কানাই চক্রবর্তী ১৯৬২ সালে তৎকালীন সময়ে চাঁদপুরের শিল্পীদের কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছাত্র-শিল্পী পরিষদ গঠন করেন ।
১৯৬৪ সালে চাঁদপুরে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান সংগীত নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। তারপর ১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি সংগঠনটির সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি শিশু একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমি চাঁদপুরের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ চাঁদপুর জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং পরপর চার বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। দুবছর জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে চাঁদপুর জেলা কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি সামাজিক ও সংস্কৃতি অঙ্গনেই নয়, ধর্মীয় আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন। তিনি চাঁদপুর হরিজন কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদে দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন। ফলে বেশক'টি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে চাঁদপুর সদর উপজেলার ৫নং রামপুর ইউনিয়নের ছোট সুন্দর এ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ২ যুগেরও বেশি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন।
১৯৭১ সালে চাঁদপুর মহকুমা ও সন্নিহিত অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে গঠিত সংগ্রাম কমিটিতে জীবন কানাই চক্রবর্তীর ভূমিকা ছিলো অসামান্য। মিনিস্ট্রিয়াল ফরম্যাটে গঠিত কমিটিতে তিনি অনেকটা তথ্যমন্ত্রীর ন্যায় দায়িত্ব পালন করে বেশ সুনামণ্ডসুখ্যাতি অর্জন করেন, যেটি সংগ্রাম কমিটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে।
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, ধর্মীয় বিষয়, সমাজসেবা, সংস্কৃতিসহ চাঁদপুরের নানা ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক অবদানের জন্যে স্বল্প ক'জন মানুষকে কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাঁদের অন্যতম শ্রদ্ধেয় জীবন কানাই চক্রবর্তী। যাঁর সামগ্রিক অবদান চাঁদপুরের ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লিখা থাকবে অনন্তকাল--এমনটিই সুধী পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য।