প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
স্বপ্ন
মাথার উপর খাড়া ভাবে কিরণ দিচ্ছে সূর্যটা। আসলে সূর্য কিরণ বলবে নাকি সৌর ঝড় বলবে তা বুঝে পাচ্ছেনা মাথায় পানির কলস নিয়ে হাঁটা ছেলেটা। প্রচণ্ড তাপে জমির মাটি ফেটে গেছে। সূর্যের তাপ থেকে নিজের মুখটাকে বাঁচাতে মাথা নিচু করে হাঁটা শুরু করবে ভেবে মাথা নিচু করতেই মনে হলো মাটির ফাটলগুলো দিয়ে যেন মাটির নিচের আরেকটা সূর্য তাপ বিচ্ছুরণ করছে। হাঁটতে হাঁটতে সে একসময় তার বাবার কাছে পৌঁছালো। বাবা মাঠে কাজ করছে।
বাবা জিজ্ঞেস করলো-'কিরে পানি কইত্তন আনছস?'
-নদী থেকে বাবা চাপ কলে পানি নাই শুখায়া গেছে।
রহিম মিয়া তার শুকনো জমিটার দিকে তাকিয়ে কিচ্ছুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ডক ডক করে পানি গিললো। ফসলগুলো যেন সূর্যের প্রচণ্ড তাপে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। সারাদিন মাঠে কাজ করা রহিম যেন নিজের থেকে তার ফসলের প্রতি ভালোবাসা। সে কৃষক কিন্তু তার ছেলে পড়ালেখা করে। একটি মাত্র ছেলে। বড় মেয়েটা চার বছর আগে পানিতে পড়ে মারা গেছে। এখন তার ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার পরিবার। তার ছেলের ইচ্ছা সেও তার বাবার মতো কৃষক হবে। রাতের বেলা ভাত খেতে খেতে বাবা মাকে সে বললো। রহিম মিঞার স্ত্রী ছেলের কথা শুনে বললো, ‘পোলা আমার কয় কি? আমার পোলা হইবো সাহেব। কোট পইরা আইসা আমারে সালাম করবো আমি মাথায় হাত বুলাইয়া দিমু। ’
রহিম মিঞা বললো, ‘বাবা তোর বাবার মতো হওয়া লাগবোনা তুই তোর মতো হইস। তোর মায়ের কথা মতো হওন লাগবো না। ’
রাকিব এবার ক্লাস ৭ম পড়ে। নিয়মিত স্কুলেও যায় আবার বাবাকে সাহায্য ও করে। ছাত্র ভালো রোল দুই। খাবার শেষ করে সবাই ঘরের দুয়ারে এসে বসলো। রাকিব আকাশের তারা গুনছে। তারপর হঠ্যাৎ গুনা বন্ধ করে দিলো। বাবা-মা আমি কেন কৃষক হবো বলেছি জানো। তারা প্রশ্ন করলো কেন? রাকিব বললো -আমি কৃষক হবো কিন্তু শিক্ষিত কৃষক। আমি বাবার মতো হাজারো কৃষকদের দু:খ দূর করার চেষ্টা করবো।
-নারে বাবা শিক্ষিত মানুষ কৃষকরে চিনে না। তারা ধান ও চিনে না। তারা চিনে শুধু টাকা আর মিথ্যা সম্মান খুঁজে। আমি তো চিনি আগামীতে আরো ভালো করে চিনবো। কারোন আমি যদি ঠিক মতো নাই চিনি তাহলে নতুন প্রজাতির ধান বানাবে কে। সূর্যের তাপে যাতে মারা না যায় এরকম মরিচ, পেয়াজ বানাবে কে বলো?
রাকিবের কথা শুনে তার বাবা মা দুজনেই খুশি হলো এবং তাকে নিয়ে অনেক আশা প্রকাশ করলো।
রাকিবের মাঠে কাজ করার পাশাপাশি পড়ালেখাও চলতে থাকলো। তারপর কিছুদিন তার পরীক্ষার সময় হয়ে গেল। বিগত কয়েক বছর অনেক কিই ঘটলো। ওইবারে খরায় অনেক ফসল নষ্ট হলো। আবার তাদের ঘর আলো করে তার ছোট বোন এলো।
আজ তার পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো। এপ্লাস পেয়েছে। বাবা মা দুইজন মহাখুশি। টাকা থাকলে সারা মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করতো। কিন্তু টাকা নেই। রাকিব এবার কলেজে ভর্তি হলো। নিয়মিত কলেজে যেতে পারে না। কারন বাবার শরীরটা কিছু খারাপ। কিন্তু সে বাড়িতে পড়ালেখা করে ঠিকমতো।
দেখতে দেখতে কলেজের ১ম বর্ষ শেষ। ১ম বর্ষের রেজাল্ট বেশি একটা ভালো হয়নি। তাই বাবা এখন তাকে মাঠে যেতে নিষেধ করে। গ্রামে কয়েকজন ছেলে আছে চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে পড়ছে। কিন্তু তার চাকরি নেই বলে গ্রামের হাই স্কুলের গেস্ট টিচার তার কাছে রাকিবের প্রাইভেটের ব্যবস্থা করা হলো। কারণ বাবা-মা না খেয়ে তাকে পড়াচ্ছেন নিজের ছেলের সপ্নপূরণ করা হচ্ছে তাদের স্বপ্ন। কিভাবে তারপর সে পরীক্ষা দিলো এবং (অনেক ভালো রেজাল্ট করলো সকল বিষয়ে ৯৫%+ নাম্বার পেলো। রাকিন রাকিব তার স্বপ্ন সম্পর্কে ভাইকে বলেছিলো তখন রাকিন বলেছিলো যে সে যেন কৃষি বিশ্ববিদ্যলয় পড়ে। এর পাশাপাশি বুয়েট এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পরীক্ষা দেয়।
রাকিব আগে চোখ খুলে চারোদিকে তাকালে শুধু বিস্তীর্ণ মাঠ দেখতে পেতো সবুজের সমারোহ দেখতে পেতো। কানে ভেসে আসতো পাখির মিষ্টি গান। ঝনমন বাতাস বইতো। রাকিব জোরে একটা নিঃশ্বাস নিলো মুক্ত বাতাসে। আকাশের দিকে তাকালে ঈগলকে দেখে মনে করতো যদি ইগল হতাম তাহলে সূর্যের কাছে চলে যেতাম গিয়ে বলতাম সূর্য মামা তোমার কিরণ কমানো যাবে। আমাদের কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু শহরে এসেছে, যেদিকে তাকায় সে দিকে দালান আর দালান। চারদিক থেকে ভেসে আসছে যান্ত্রিক যত শব্দ। পঁচা, ড্রেনের গন্ধ আর ধূলোবালির কারণে নিঃশ্বাষ নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ভাবছে যদি নিঃশ্বাস না নিয়ে বাঁচা যেতো। কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলো রাকিব, মেসে থাকে মেসের খাবার খেতে খুবই কষ্ট হয় তার। শহরের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছেনা কোন বন্ধুও নাই। কাল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা কিন্তু রাকিবের অনেক জ্বর কয়েকদিন যাবৎ। ভালো মতো প্রস্তুতি নিতে পারছেনা। সকালে ঘুম থেকে উঠে পরীক্ষা দিতে গেলো। রহিম মিয়া পরীক্ষা শেষে বেরিয়ে আসলো। আসলো রাকিবের পরীক্ষা ভালো হয়নি। সরাসরি বাড়ি চলে আসলো রাকিব। বুয়েটের পরীক্ষা ছিলো না, সে অবশ্য ঢাকা বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলো।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে, রাকিব কৃষিতে টিকেনি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকেছে। কিন্তু রাকিব মানসিকভাবে বির্পযস্ত। কারণ সে আগেই জানতো সে টিকবে না। তাই সে একটুও আনন্দিত নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। সে ভর্তি হলোনা। কারণ তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় নি, সে ভেঙ্গে গেছে। এভাবে রাকিব সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে। এখন বাবার মাঠেও যায় না ঠিক মতো খায় না।
প্রচুর রোগা হয়ে গেছে রাকিব। এভাবে এক বছর হয়ে গেলো। একদিন হঠাৎ তার ছোটবোন মিলে তাকে বললো ভাই বাবা মাঠে ঘুরে পরে গেছে। প্রথমে রাকিব তেমন কিছু মনে করলো না, পরে হঠাৎ বাড়িতে সোরগোল পড়ে গেছে। তার বাবা স্ট্রোক করেছে। ভালো হাসপাতালে নিতে নিতে তার বাবা মারা গেলো। তার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেলো, ফসলের মাঠে এখন কেউ যায় না। তার মা-তো এ শোকে কাতর। বাড়ির খাবার ফুরিয়ে আসলো, এখন রাকিবের একটু হুস।
আসলে তার মনে হলো যে এভাবে থাকলে তার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ হবে। সে মাঠে কাজ করা শুরু করলো। জি কিছুই বদলে যায়নি, এই মাঠ শুধু বদলে গেছেম, সে এবং তার জীবন। তারপর সে তার বাবার মতো মাঠে কাজ করে তার পরিবার চালাতে লাগলো। সে কলেজে থাকাকালীন কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন বিষয় শিখেছে। যা তার জমিতে প্রয়োগ করে অনেক ভালো ফসল পেলো এবং গ্রামে সে এর পাশাপাশি শাক-সবজি ও বিদেশী আলু চাষ শুরু করলো। যার ফলে রাকিব অনেক লাভবান হলো। তারা নতুন বাড়ি করলো আরো জমি কিনলো। তাদের পরিবারে সুখ আসলো। কিন্তু রাকিবের সেই বিধ্বস্ত হৃদয়ের রক্তক্ষরণ যেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি। হঠাৎ যেন তা নাড়া দেয়। কোন এক গভীর রাতে তার ইচ্ছে করে সে আবার নতুন করে পড়বে আবার পরীক্ষা দিবে। কিন্তু তা কী আর সম্ভব।