প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
মেঘের সাথে জোছনা রাতে
মেঘ আমার কাছে চির বিস্ময়ের। বিশেষ করে সাদা মেঘ। তুলোর মতো নরম। পালকের মতো হাল্কা। ডানা ছাড়া মেঘগুলো কীভাবে আকাশে ভেসে থাকে তা আমি ভেবে উঠতেই পারি না। শুনেছি পৃথিবী নাকি সবকিছুকেই তার কেন্দ্রের দিকে টানে। তাহলে সাদা মেঘ কীভাবে ভেসে থাকে! একটা কাগজের টুকরো এরোপ্লেন হতে নীচে ফেলে দিলে পৃথিবীর টানের কারণে মাটিতে পড়ে যায়। অথচ সাদা মেঘেরা কত সহজেই আকাশে ভেসে থাকে! দিনের বেলা সূর্যের প্রখর তাপের কারণে সাদা মেঘের দিকে তাকাতে পারি না। তবে রাতের কোমল আলোয় মেঘেরা রূপবতী হয়ে ওঠে আরো। মেঘেদের অনেক রঙ। কালো, ধূসর, লালাভ, পানিতে ডেটলের ফেনার মতো সাদা। গোধুলির মেঘের রঙ হিঙুলের মতো। আবার কোন কোন মেঘ কড়ির মতো শুভ্র, কোন কোন মেঘ খইরঙা। আমার অতো মেঘে কাজ নেই। আমি বলছি সাদা মেঘের কথা। মেঘেরা যেন আকাশে উড়ে চলা বকের বংশ। উড়ে চলেছে তো চলেছেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, মেঘের চেয়ে সুখি আর কিছুই নেই। তাদের এক দেশ হতে আরেক দেশে যেতে কোন মানা নেই। কোনো সীমান্ত তাদের জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। মেঘেরা তাই বিশ্বনাগরিক। মাঝে মাঝে মন চায় মেঘের লুকোনো ডানা দুটো খুঁজে বের করি। মেঘেরা আদৌ বুকে হাঁটে নাকি উড়ে যায় তা-ও বুঝি না। মেঘেদের চেনার কোন উপায় নেই। কোনটা বাংলাদেশের, কোনটা ভুটানের তা বুঝা যায় না। সব দেশের মেঘই একরকম।
একবার শরতের এক দুপুরে বাসার কাছেই সবুজ মাঠে বসে নীল আকাশে সাদা মেঘের শোভা দেখেছিলাম। সাদা মেঘের নিরালায় আকাশকে আরো নীল মনে হয়েছিল। অনেকটাই চিড়িয়াখানায় দেখা ময়ূরের মতো। সেই নীলের বিপরীতে সাদা মেঘের আকৃতিকে দেখে মনে হয়েছে কুলপি আইসক্রিম। এই বুঝি গলে গেলো। কিন্তু গলছে না। প্রতিদিন সূর্যের আলোয় মেঘের নকশা দেখি, কিন্তু রাতের মেঘের নকশা দেখার সুযোগ হয় না। শহরের কৃত্রিম আলো আর আকাশছোঁয়া ভবনগুলোর কারণে আমার কখনো রাতের আকাশে মেঘের দলাদলি দেখা হয়নি। তাই আমি সুযোগের অপেক্ষায় থাকি, কখন শরতের পরিষ্কার আকাশে রাতের মেঘের ভেসে চলা দেখতে পাবো। শারদীয়ার পূজা উপলক্ষে বেশ কয়েকদিন স্কুল ছুটি। মা এই সুযোগে গ্রামের বাড়িতে আমাদের নিয়ে যাবে। আমার আর ভাইয়ের মন তাই খুশিতে উড়ু উড়ু। আমাদের গ্রামের বাড়ি নদীর কাছাকাছি। নদী জোয়ারে ডাকলে আমরা বাড়িতে বসেই শুনতে পাই। আগে ভাঙনের ভয় ছিল। এখন নদীর পাড় বাঁধাই হওয়াতে আর পাড় ভাঙার ভয় নাই। আমাদের গ্রামের বাড়ির দোতলার ছাদ হতে নদীর শোভা দেখা যায়।
গ্রামে যাওয়ার কথায় একটু খুশি হলাম এজন্যে যে, প্রবারণা পূর্ণিমায় গ্রামে ফানুস উড়ানো হয়। অনেক বড় বড় ফানুস। ফানুস ওড়ানো খুব সহজ। প্রথমে ফানুসের মুখে বাঁধা তারে মোমের টুকরা পেঁচিয়ে দিতে হয়। তারপর সেই মোমের টুকরায় আগুন ধরিয়ে দিতে হয়। আগুন জ্বলতে শুরু করলে মোম পুড়ে গ্যাস হয়। এই গ্যাস হাল্কা বলে ফানুসের ভিতরে গায়ে উপরের দিকে ধাক্কা মারে। একসময় ফানুসের গ্যাসের চাপ বাড়লে আস্তে করে হাতের মুঠোতে ধরে থাকা ফানুসের কিনারা ছেড়ে দিতে হয়। ফানুস তখন হু হু করে উড়ে যায় আকাশে। যদি বাতাস অনুকূলে থাকে তবে তো কথাই নেই। ফানুস খুব দ্রুত উড়ে যাবে দূরে বহুদূরে। অনেক সময় কপাল খারাপ হলে বাতাসের প্রবাহ না থাকলে ফানুস বেশিদূর আগায় না। একটু উঠেই পড়ে যায়।
আমরা সময়মত রওনা দিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছি। গ্রামে যেতে হলে ট্রেনে ভোরবেলায় চেপে কাকার বাসায় যাই। তারপর সেখান থেকে সদলবলে চলে যাই গ্রামে। যাওয়ার পথে নদীর ওপর একটা ব্রিজ পার হতে হয়। ব্রিজের দুই পাশে নৌকার সমাহার চোখ জুড়িয়ে দেয়। আগে আমার দাদুরা নৌকায় চড়ে নদী পার হতো। এখন আমরা সরাসরি গাড়ি করে রওনা দিই কাকার বাসা হতে। গাড়ি ঠিক আমাদের বাড়ির ঘাটায় নামিয়ে দেয়। প্রথম দিকে কিছু সময় যায় গ্রামের সবার সাথে কুশল বিনিময় করতে। আমরা ছোটরা অবশ্য এসব করতে হয় না। আগামীকাল পূর্ণিমা। অর্থাৎ আগামীকালই আকাশে ফানুস উড়বে। আমি মনে মনে খুশি হই। আজ রাতেই চাঁদমামাকে পাবো পূর্ণ আলোয়। আকাশ পরিষ্কার। কেবল সাদা মেঘ ছাড়া। অর্থাৎ আজ রাতে বৃষ্টি হবে না। সুতরাং আজ রাতে জোছনায় মেঘের সাথে আমার দেখা হবে, কথা হবে। সারা দুপুর দৌড়ে, খেলে কাটালাম। বিকেলে নদীর পাড়ে বসে মাঝিদের নৌকা বেয়ে যাওয়ার কসরত দেখে মুগ্ধ হয়েছি বেশ। আমাদের নদীর এপারে তেমন কাশফুল ফোটেনি। কিন্তু ঐ পাড়ে সাদা কাশের হাসি মন কেড়ে নেয়। মনে হলো যেন তুলোর বিছানা। কিংবা ঠাকুরমার সাদা শাড়ি বিছিয়ে কেউ যেন শুকোতে দিয়েছে রোদে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে গেছে। ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে উঠেছে।
আমাদের গ্রামে পল্লীবিদ্যুতের আলো ঝলমল করছে গত কয়েক বছর ধরে। গ্রামে এলে মায়ের কড়াকড়ি থাকে না। মা যেন হঠাৎ খুব ভালো হয়ে যায়। পড়ার চাপ নেই, খাওয়ার ডাকাডাকি নেই, টিচারের বাসায় যাওয়ার তাগাদা নেই। মনে মনে ভাবি, সারাটা জীবন যদি এভাবেই যেতো! আমার কাকা ছোটবেলায় নাকি খালি পড়া ফাঁকি দিতো। দাদু একদিন একটা বেত নিয়ে কাকাকে ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, তুই যে পড়িস্ না, তুই বড় হলে ভাত খাবি কী করে? ছোট কাকা নাকি তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিল, কেন, গুড়াদি রাঁধবে আর আমি খাবো। এখন যেমন খাই। গুড়াদি হলো আমার সেজো পিসি। কাকার জবাব শুনে দাদু হেসে দিয়েছিলেন। আমি দোতলার ছাদে উঠতে উঠতে বাবার বলা এই গল্পটা মনে পড়ল। আমাদের দোতলার ছাদটা বেশ বড়। চারপাশে রেলিং দেয়া দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই ছাদে। কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটা দোলনা এককোণায় পাতানো। আমি বেশ আরাম করে দোলনায় বসলাম। হাতে বাঁধা ঘড়িতে আটটা বাজে রাত। আমি এখন একাকী ছাদে বসে আছি। নিজেকে একটু বড় বড় মনে হচ্ছে। একা ছাদে এর আগেও দু'চারবার ছিলাম। অনেকের ভূতের ভয় থাকে। আমার কোন ভূতের ভয় নেই। ভূত থাকলে তবে তো ভূতের ভয়। পুরো ছাদজুড়ে জোছনা লুটিয়ে পড়েছে। গলানো রূপোর স্রোতের মতো। মনে হচ্ছে জোছনার বান। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদটা পুরোপুরি গোল। বড়সড় একটা তন্দুর রুটির মতো গোল। চাঁদকে ঝলসানো রুটি বলে গেছে সুকান্ত। আর আমার কাছে মনে হলো সাদাটে তন্দুর রুটি। মাঝে মাঝে হাল্কা দাগ লাগা। চাঁদের আলোয় আশেপাশের সাদা মেঘগুলো হেসে উঠল। মনে হচ্ছে মেঘগুলো কোন দূর্গের প্রাচীরের শীর্ষ। কাজকরা আর খাঁজকাটা। আমি বোধ হয় কোন প্রাচীন সভ্যতার দেশে ঢুকে গেছি। রহস্যমাখা মুখ নিয়ে সাদা মেঘ যেন মুখ টিপে হাসছে আমাকে দেখে । আমি খুঁটিয়ে খু্েিটয় জোছনা রাতে চাঁদের আলোয় সাদা মেঘেদের দেখছি। মনে হোল মেঘেদের মধ্যে পরীমেঘও আছে। খুব সুন্দর কোঁকড়ানো চুল। পরী আমায় ডাকছে। এসো এসো। আমি পরীকে বললাম, তোমরা কোন দেশে যাও? পরী বললো, আমরা মেঘে মেঘে ভেসে ভেসে পরীরাজ্যে যাই। সেটা কোথায়? ওই যে আকাশের ওপারে। আকাশের ওপারে! ওখানে আর কী আছে? ওখানে আছে পৃথিবীর যমজ জগৎ। কী বললে? যমজ জগৎ? সেটা আবার কী? ওহ্! তুমি জানো না? পৃথিবীতে যেমন তুমি আছো তেমনি তোমার যমজ মানুষটা আছে আকাশের ওপারে। ওখানে তোমার ভাই আর তোমার মায়ের যমজও আছে। তাই নাকি? আমাকে কি নেওয়া যাবে ওখানে? পরী বললো, ঠিক আছে নেওয়া যাবে। তবে তোমার চোখ বন্ধ করতে হবে। কেন? চোখ বন্ধ করতে হবে কেন? কারণ চোখ বন্ধ না করলে তুমি ভয় পেয়ে অতো উঁচু থেকে পড়ে যেতে পারো। ওকে ঠিক আছে। আমি তাহলে চোখ বন্ধ করলাম। পরী একটা অস্ফুট শব্দ করলো। আমি শুধু টের পেলাম, আমি উড়ছি শূন্যে। ভয়ে চোখ খুলছি না। উপরে উঠছি তো উঠছিই। কানে শুনতে পেলাম পরীকে কে জানি শাঁসাচ্ছে। তুমি পৃথিবীর মানুষকে কেন আকাশের এপারে আনলে? তুমি কি জান না এখানে শুধু পৃথিবীর বিপরীত যমজেরাই থাকে। যাও ওকে রেখে এসো যেখান থেকে নিয়ে এসেছো সেখানে। পরী বললো না। ওকে আমি কথা দিয়েছি এখানে আনবো। তুমি আমাকে যেতে দাও। ওকে আবার আমি রেখে আসবো পৃথিবীতে। শুধু ও তার বিপরীত যমজকে দেখতে চায় নিজের চোখে। উঁহু। তা হবে না। এখানে আমার কথাই আইন। আমিই এখানের নিয়ন্ত্রক। যাও তুমি ওকে রেখে এসো। না আমি ওর বিপরীত যমজকে না দেখিয়ে ফেরৎ নিয়ে যাবো না। পরীর কথা শুনে আকাশের ওপারের রাজ্যের নেতা পরীর সাথে লড়াই শুরু েেকর দিলো। লড়াই করতে গিয়ে পরী আমাকে ছেড়ে দিলো অগত্যা। আমি খুব বেগে পড়তে শুরু করলাম নিচে। আমি চিৎকার করে উঠলাম।
কিছু বুঝে উঠার আগেই ধপাস করে একটা শব্দ হলো। শব্দ শুনে নিচ থেকে মা, কাকা আর অন্যরা উঠে এলো। আমি টের পেলাম, দোলনায় নয়, আমি পড়ে আছি ছাদের মেঝেতে। চারদিকে একটা হাসির রোল বয়ে গেল। ব্যথায় কাতর হলেও আমি শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছি পরীটাকে। কারও হাসি তখন আমার কানে ঢুকছেই না। একদমই না।