প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৩৭
শিক্ষা সংস্কারে প্রযুক্তির ছোঁয়া
|আরো খবর
কিন্তু প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা পরীক্ষানির্ভর, সনদ-সর্বস্ব এবং একই সঙ্গে আনন্দহীন। তাই এসব মৌলিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে চলমান শিক্ষাব্যবস্থায়, যা ২০১২ সাল থেকে চলমান। সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন হিসাব করে আগামী বছর (২০২২ সাল) থেকে কার্যকর হতে পারে এমন একটি শিক্ষা সংস্কারের কাজ চলছে, যেখানে বাতিল হতে পারে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা। একই সঙ্গে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক নামে কোনো বিভাগও থাকছে না। একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগ নির্বাচন করবে। এর ফলে এতো দিন ধরে চলে আসা মাধ্যমিক শিক্ষার পুরো চিত্রটাই পাল্টে যাচ্ছে।
নতুন পাঠ্যক্রমে মাধ্যমিকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ১০টি বিষয় পড়তে হবে। এগুলো হচ্ছে ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, জীবন ও জীবিকা, পরিবেশ ও জলবায়ু, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। এই ১০টি বিষয়কে ‘শিখনক্ষেত্র’ অভিহিত করে তিনটি মূল যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে রচিত হচ্ছে নতুন পাঠ্যক্রম।
এগুলো হচ্ছে উদ্ভাবনী, পারস্পরিক সংযোগ স্থাপন এবং জবাবদিহি। প্রস্তাবিত শিক্ষা সংস্কারে মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজন না থাকায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল ও ইংরেজি-বাংলা ভাষা সবই পড়তে হবে। ফলে মাধ্যমিক পাসের সময় একজন শিক্ষার্থী সব ধরনের প্রাথমিক জ্ঞান নিয়ে বের হবে, যা তাদের পরবর্তী কর্মজীবনে অনেক সহায়ক হবে।
প্রস্তাবিত কারিকুলামে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দুই বছরমেয়াদী এবং তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। চতুর্থ থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ৭০ শতাংশ নম্বর থাকবে ধারাবাহিক মূল্যায়নে। এছাড়া অষ্টম-নবমে ৬০ শতাংশ, দশমে ৫০ শতাংশ এবং এইচএসসিতে ৩০ শতাংশ নম্বর ধারাবাহিক মূল্যায়নের আওতায় আসবে। প্রাথমিকভাবে শুধু চারটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই দেয়া হবে। শ্রেণি চারটি হচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম। অর্থাৎ প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের আলোকে এখন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম তৈরি হচ্ছে। ২০২৩ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যবই পাবে। ২০২৪ সালের মধ্যে দশম শ্রেণি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমে বই প্রবর্তন শেষ হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়নও হবে নতুন পদ্ধতিতে। দশম শ্রেণিতে ক্লাসের পড়া বইয়ের ওপর ভিত্তি করে হবে এসএসসি পরীক্ষা। এইচএসসি পরীক্ষা দুই বছরে দুবার নেয়া হবে। প্রথমে একাদশ শ্রেণিতে পড়া বিষয়গুলোর ওপর বছর শেষে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। এর নম্বর নিজ নিজ শিক্ষা বোর্ড সংরক্ষণ করবে। পরে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া বিষয়ের ওপর আবার পরীক্ষা দেবে শিক্ষার্থীরা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ফল যোগ করে এইচএসসির ফল ঘোষণা করা হবে।
সংস্কারের পর্যায়ে আছে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও। তুলে দেয়া হচ্ছে দেশের ৩১৫টি বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স কোর্স। তবে চলমান থাকবে ডিগ্রি পাস কোর্স, পাশাপাশি থাকবে বিভিন্ন শর্টকোর্স এবং ইন্ডাস্ট্রি ও জীবনভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা যেমন টেকনিশিয়ান, ইলেকট্রিশিয়ান, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন মেরামত, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, কৃষিকাজে পারদর্শী ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি অনার্স কলেজে লেখাপড়া করে চাকরি পান না অনেকে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিরাট ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়, তৈরি হয় হতাশা। শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সমাজের জন্যে এটি মোটেও সুখকর নয়। বর্তমান সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছেন। বর্তমানে দেশে ৪৬টি সরকারি এবং ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কাজেই যারা অনার্স-মাস্টার্স করবেন তারা পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কাক্সিক্ষত ডিগ্রি নিতে পারবেন।
প্রস্তাবিত সংস্কারে ছাত্র-শিক্ষকের আনুপাতিক হার আন্তর্জাতিক মানের হওয়া, একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন, সৃজনশীল প্রশ্নসংবলিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্লাস-পরীক্ষা ও ফলাফল তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক কোর্সের পরিবর্তে বছরে দুটি সেমিস্টার এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে তিনটি সেমিস্টারের পরিবর্তে দুটি সেমিস্টার প্রচলন করা দরকার। বর্তমানে জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় শিক্ষায়, যা খুবই অপ্রতুল। বরাদ্দ বৃদ্ধি করে শিক্ষার এই বৈষম্য দূর করা দরকার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা সীমিত থাকায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে।
সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান খুবই ভালো। তাই পুরস্কারস্বরূপ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পর্যায়ক্রমে সরকারি সহায়তা দেয়া যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীদের বেতনের হার গরিব ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাধ্যের মধ্যে থাকে। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস্, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংকস্, ব্লকচেইন, ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং, সাইবার সিকিউরিটি, আইটি ফরেনসিক, ক্লাউড কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি আধুনিক কোর্সের সমন্বয়ে অটোমেশন প্রযুক্তির মিশেলে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। কিন্তু এসব প্রযুক্তিতে এখনো অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। তাই উচ্চশিক্ষায় এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি প্রস্তাবিত সংস্কারে থাকতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়াও।
শিক্ষার সর্বস্তরে শিক্ষার্থীর জন্যে ছবিসংবলিত নির্দিষ্ট আইডি এবং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। পরীক্ষার নম্বর, ফলাফল, মার্কশীট এবং সার্টিফিকেট ওই নির্দিষ্ট আইডির মাধ্যমে ডেটাবেইসে সংরক্ষণ থাকবে। শিক্ষার্থীদের যখন দরকার তখনই ওই আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে পারবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের ডকুমেন্ট/রিপোর্ট শুধু দেখতে, ডাউনলোড এবং প্রিন্ট করতে পারবে, কোনো ধরনের পরিবর্তন করার সুযোগ পাবে না। তবে কোনো কারণে পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে কর্তৃপক্ষের সহায়তা নেবে।
গ্রাম-হাওর-বিচ্ছিন্ন এলাকায় ডিজিটাল ডিভাইস এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্য করা, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের দিকে অগ্রসর হওয়া, অডিও-ভিডিও-রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা-সংবলিত ডিজিটাল রিসোর্স এবং এডুকেশন টুলস্ ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ক্লাস অ্যাটেনডেন্স থেকে শুরু করে ফলাফল প্রস্তুতকরণ, অফিসের ফাইল প্রসেসিং সবকিছু কম্পিউটারাইজ্ড করা দরকার। একই সঙ্গে চলমান অনলাইন ক্লাসগুলোকে বিশেষায়িত অ্যাপের মাধ্যমে আরও বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব করে তৈরি করা এবং অনলাইনে পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করা উচিত। শিক্ষা-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য যেমন পরীক্ষার তারিখ, ফি জমা দেয়া, ক্লাসে অনুপস্থিত, বেতন, বৃত্তি ও জরিমানার টাকা লেনদেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ-খোলা ইত্যাদি তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে অবহিতকরণ, পরিবহন টিকিট, ক্যাফেটেরিয়ায় খাওয়া-দাওয়ার বিলসহ ক্যাম্পাসভিত্তিক সব লেনদেন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অনলাইনে করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবেই পরিপূর্ণতা পাবে সংস্কারের উদ্দেশ্য।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, অধ্যাপক ও পরিচালক আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।