প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১০:৪২
বৃষ্টির দিনে শহর জাগানো

গন্ধর্বপুর শহরটা খুব একটা বড় নয়। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরটি যেন প্রাচীন স্মৃতির বুকে মাথা উঁচু করে দঁাড়িয়ে আছে। মাঝ দিয়ে চলে গেছে সরু একটি খাল। খালের পাশে ছোট ছোট দোকান, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, একটি লাইব্রেরি, এবং কয়েকটি ছায়াঘেরা গলি। এই শহরের মানুষজন সরল, আন্তরিক, সবাই সবাইকে চেনে।
এই শহরেই থাকে রাহাত। বয়স মাত্র ১১, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু চিন্তাভাবনায় সে অনেক পরিণত। তার বন্ধুদের চেয়ে আলাদা একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে পরিবেশ আর সমাজকে ঘিরে। তার বাবার মুখে শুনেছে—গন্ধর্বপুর এক সময় কতটা সুন্দর ছিল! খালের পানি এত স্বচ্ছ ছিল যে মাছের ছায়াও দেখা যেত। এখন সেখানে ভাসে প্লাস্টিক, বোতল, পঁচা সবজি, আর দুর্গন্ধে ভরা স্যঁাতসেঁতে জল। বর্ষার শুরুতেই শহরে নেমে এলো একটানা বৃষ্টি। প্রথম দিনটা বেশ মজা—স্কুল ছুটি, জানালার পাশে বসে গরম মুড়ি-চানাচুর খাওয়া আর বাইরে কুয়াশার মতো ঝর্নার শব্দ শুনে সময় কাটানো। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকেই সমস্যার শুরু। তৃতীয় দিন দুপুরের পর চারপাশ একেবারে অচল হয়ে গেল। স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। রাস্তায় হঁাটু পানি। খালের মুখে জমেছে আবর্জনা। পানি বের হতে পারছে না, ড্রেন উপচে উঠেছে। পাড়ার মসজিদের সামনের রাস্তায় ছোট বড় সবাই পড়ে যাচ্ছে। বাজারে যেতে কষ্ট, ছোট দোকানগুলো পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
লোকজন একে অপরকে দোষ দিতে শুরু করল। “এই শহরে আর বঁাচা যায় না!” “কাউন্সিলর কী করে?” “ড্রেন পরিষ্কারের লোক কোথায়?” “এই দেশে কিছুই ঠিক নেই!” শুধু অভিযোগ, আর অভিযোগ। রাহাত এ দৃশ্য দেখে খুব কষ্ট পেলো। বাসার সামনে দঁাড়িয়ে দেখতে লাগল কেমন করে তার চেনা শহরটা পানিতে ডুবে মরছে, আর সবাই মুখে শুধু অভিযোগ করে, কিন্তু কেউ কোনো কাজ করছে না।
সন্ধ্যায় দেখা হলো তার চার বন্ধুর সঙ্গে তিথি, জহির, রুমা আর সুমন। সবাই একই পাড়ায় থাকে, একই স্কুলে পড়ে। তাদের আড্ডার জায়গা ছিল পাড়ার মোড়ের পুরোনো চায়ের দোকানের ছায়ায়। বৃষ্টির দিনেও তারা ভিজে ভিজে দেখা করতে এলো। তিথি বলল, “রাস্তায় পানি, ড্রেন বন্ধ, বাসা থেকে বের হওয়া যায় না। সব খেলা বন্ধ।” জহির মুখ বঁাকিয়ে বলল, “যাদের দায়িত্ব তাদের দেখি না। বৃষ্টিতে তো তারাও গা ঢাকা দিয়েছে।” রুমা বলল, “কিন্তু এভাবে থাকলে তো আরও খারাপ হবে। রোগ ছড়াবে, দুর্গন্ধ বাড়বে।” সুমন এক গাল হেসে বলল, “আমরা যদি মিলে কিছু করি?” তিথি অবাক, “আমরা? এত বড় কাজ? শহর পরিষ্কার করব?”
সবাই চুপ। তখনই রাহাত দৃঢ় গলায় বলল, “হ্যঁা, আমরা পরিষ্কার করব। কেউ যদি না করে, তাহলে ছোট হলেও আমাদের চেষ্টা করতে হবে।” রাহাত পরিকল্পনা করল। পরদিন সকালে সবাই নিয়ে কাজ শুরু করবে। সবাই গ্লাভস, পুরোনো জামা-কাপড়, ঝুড়ি, প্লাস্টিক ব্যাগ আর কাঠের লাঠি আনবে। উদ্দেশ্য ড্রেন পরিষ্কার করা, খালের মুখে জমে থাকা ময়লা সরানো, রাস্তার পাশ থেকে প্যাকেট আর প্লাস্টিক কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলা। রাতটা তারা উত্তেজনায় কাটাল। কারো ঘুম এলো না। কেমন হবে কালকের দিন? কেউ হাসবে না তো? কেউ বাধা দেবে না তো? পরদিন সকালবেলা বৃষ্টি একটু থেমেছে। চারদিকে কাদা, গাছের পাতায় পানি ঝরে পড়ছে। রাহাত, তিথি, জহির, রুমা আর সুমন ছাতা, গামবুট পরে, হাতে গ্লাভস আর ঝুড়ি নিয়ে হাজির হলো খালের পাশে। তারা শুরু করল কাজ। পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, মরা ডাল—সব তুলে তুলে ঝুড়িতে ফেলল। এক জায়গায় একটা বালতিতে মরা ইঁদুর দেখে রুমা ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেল, কিন্তু তিথি সাহস দিয়ে বলল,“ভয় পেলে হবে না রুমা। আমাদের শহর বঁাচাতে হবে!”
প্রথম এক ঘণ্টা কেটে গেল কাজ করেই। রাহাত একটা কাঠি দিয়ে ড্রেনের মুখ খেঁাড়ার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ জলের গর্জন শুনে সবাই তাকালো পানি বেরিয়ে যাচ্ছে! একটু পরেই খালের দিকে পানির ধারা গড়িয়ে চলতে লাগল। বন্ধ জল চলাচল আবার শুরু হলো। তাদের চোখে-মুখে আনন্দ। ছোট্ট শহরের মাটিতে যেন প্রাণ ফিরে এলো। কিছুক্ষণ পর পাশের দোকানদাররা বেরিয়ে এসে দেখে অবাক হয়ে গেল।
এই পিচ্চিরা কাজ করছে?” ‘বাহ! ওদের তো সম্মান জানানো উচিত।’ ‘আমরা তো এমন কিছু ভাবিওনি!’ প্রথমে যাদের চোখে ছিল হাসি, তারা এখন হাততালি দেয়। পাড়ার একজন যুবক এসে বলল, ‘ভাই, আমি তো দেখি বসেই ছিলাম। তোমরা আসলেই অনন্য!’ একজন বৃদ্ধা হঁাপাতে হঁাপাতে এসে বললেন, ‘বাচ্চারা, তোমরা তো আমাদের লজ্জা দিয়ে দিলে!’
তাদের সঙ্গে আরও কিছু কিশোর-কিশোরী যোগ দিল। কেউ ঝাড়ু নিয়ে এল, কেউ পানি ঢালার বালতি। এক মায়ের চোখে জল, তিনি তার ছেলেকে বললেন, ‘ওদের সঙ্গে থাকো, আজ তোমরা সত্যিকারের নায়ক।’
সন্ধ্যার আগেই খালের মুখ পুরোপুরি পরিষ্কার। খালের পাশে ছোট্ট সাইনবোর্ড লাগানো হলো: ‘খালে ময়লা ফেলা নিষেধ।’ সেদিন শহরের মানুষ হঁাটতে হঁাটতে গল্প করে ‘এই পিচ্চিগুলা না থাকলে বুঝি আমরা এভাবে জেগে উঠতাম?’
রাতেই একজন ফেসবুকে ছবি আপলোড করল। “রাহাত আর তার বন্ধুরা আজ যা করল, তা আমরা বড়রা কথায় বলি। কাজে নয়।’
ছবির ক্যাপশন : “বৃষ্টির দিনে শহর জাগানো।” এই পোস্ট ভাইরাল হলো। পত্রিকা খবর ছাপাল, টিভি রিপোর্টার এলো। পরদিন সকালে পৌরসভার চেয়ারম্যান নিজে এলেন। তিনি শিশুদের দেখে হাসলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছো। আজ থেকে গন্ধর্বপুরে ‘পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ’ থাকবে, আর তোমরাই হবে তার নেতৃত্ব। তোমাদের কাজ শহরের ইতিহাসে লেখা থাকবে। রাহাত মাথা নিচু করে বলল, ‘আমরা শুধু ভালোবাসা দিয়েছি শহরটাকে।’ চেয়ারম্যান মুচকি হেসে বললেন, ‘ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় শক্তি।’
এরপর থেকে গন্ধর্বপুর বদলে গেল। খালপাড়ে বড় বড় সাইনবোর্ড লেখা হলো: ‘পরিবেশ ভালো রাখুন, জীবন বঁাচান।’ স্কুলে গঠিত হলো পরিবেশ ক্লাব। রাহাত, তিথি, সুমন, রুমা ও জহির সদস্য। শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতা টিম গঠন হলো। লোকজন এখন নিজেরাই বলছে ‘শিশুরা যদি পারে, আমরা পারব না কেন?’ ‘ছোট হাতের শক্তি তো বড় মন তৈরি করে।’ শহরের প্রতিটি শিশুর মুখে নতুন স্বপ্ন। পাড়ার মুরুব্বিরা এখন রাহাতদের দেখে বলে, “এরা বড় হয়ে আমাদের চাইতেও বড় নেতা হবে।” রাহাত কোনো বড় স্বপ্নের কথা বলে না। সে শুধু প্রতিদিন বলে:“এই শহরটা আমাদের, ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চাই না।”