রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৫ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩৩

আমিরাবাদ গোলাম কিবরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান

৪১ বছর পর ভূবনেশ্বর স্যারের সাথে দেখা

ড. আব্দুস সাত্তার
৪১ বছর পর ভূবনেশ্বর স্যারের সাথে দেখা

শিক্ষক সমাজ জাতি গঠনের কারিগর। একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন তার অনুসারীদের জ্ঞান ও ন্যায় দীক্ষা দিতে। শিক্ষার্থীর মানবতাবোধকে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকে সার্থক করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেন। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদেরকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন। আমার জীবনেও সেই রকম একজন শিক্ষক পেয়েছিলাম যার নাম বাবু ভূবনেশ্বর পাল। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত আমেরিবাদ গোলাম কিবরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করে প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হয়ে রিটায়ার্ড করেন। স্কুলের পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠানে ৪১ বছর পর স্যারকে দেখে মনে হল তিনি আগের মতোই আছেন। মনে পড়ে গেল স্যারের সেই শাসনের কথা। স্যার বিজ্ঞান পড়াতেন। আচ্ছা আমরা বিজ্ঞানের কি বুঝি! আমরা কি চাঁদে/মহাকাশে যাব নাকি? আমাদের বিজ্ঞান জানতেই হবে? পড়া না পারলে স্যার টেবিলের উপর দুই কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতেন।

সবচেয়ে মজার এবং বেদনার ঘটনা হল ১৯৮২ সালের। আমাদের স্কুল থেকে প্রতি বছর অষ্টম শ্রেণী থেকে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দিত এবং প্রতি বছর ৩/৪ জন বৃত্তি পেত। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর স্কুলে টেস্ট হতো যারা টিকে তারাই পরীক্ষা দিতে চাঁদপুর সদরে যেত। কেন জানি ১৯৮২ সালে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য কোন তাগিদ ছিল না। আমরা হয়তো মনে করেছি এবার আর বৃত্তি পরীক্ষা আমাদের স্কুল থেকে দেবে না। আমাদের ধারনা ভুল! হঠাৎ তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন স্যার (মরহুম) বললেন, তোমাদের আগামী সোমবার পরীক্ষা দিতে হবে, মানে ৫ দিন পর। আমারা সবাই বললাম, স্যার এই স্বল্প সময়ে কিভাবে পরীক্ষা দিব? আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পরীক্ষা দিব না। মেয়েরা রাজি হল না স্যারদের মারের ভয়ে। আসলে মেয়েরা একটু ভীতু টাইপের হয়! কিন্তু ছেলেরা ক্লাস থেকে বাহির হয়ে সোজা উত্তর পশ্চিমে মিয়ার বাজারে চলে গেলাম। এদিকে স্যাররা আমাদের স্কুলের আশপাশে খুঁজে পেলেন না, আর পাবে কি করে তখন কি আর আইফোন, হোয়াটসআপ, মাসেঞ্জার, ভাইভার, ইমু বা সেল ফোন ছিল নাকি। হেড স্যার আমার আব্বা মরহুম জয়নাল আবেদিন (জনু) হাজরা সাহেবকে খবর দিলেন জরুরি স্কুলে আসার জন্য। আমার আব্বা লাইব্রেরীর সামনে আসলেই প্রধান শিক্ষক বলেন, আপনার ছেলে, বিল্লাল, মরহুম নুরুজ্জামান, আসাদুজ্জামান, সালাউদ্দিন, বাকী, মর্তুজা, ফারুক ও জাকির ওরা পরীক্ষা না দিয়ে কোথায় জানি চলে গেছে। আব্বা আমাদেরদেকে খুঁজতে যাবে এমন সময় আমাদের এক ক্লাসমেট হোসেন বলেÑওদেরকে দেখেছি উত্তর মিয়া বাড়ির দিকে যেতে। আব্বা আমাদের খুঁজে পেলেন উত্তর পশ্চিম মিয়ার বাজারে। আমরা বসে চা খাচ্ছিলাম। আব্বা আমাদেরকে বলেন, তোমরা সবাই স্কুলে চলো হেড মাস্টার সাহেব বলেছে পরীক্ষা পিছিয়ে দিবে। আমাদেরকে সোজা লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল। লাইব্রেরিতে যাওয়ার সাথে সাথে করিম স্যার দরজা বন্ধ করে দিল। আমার আব্বা মনে করছে আমাদের সাথে কথা বলে বুঝিয়ে দিবে। করিম সার প্রথমেই দুইটা বেত হাতে নিয়ে বিল্লালের চুলে ধরে কি মারটাই না মারল। বিল্লাল চিৎকার করে বলতেছিল, আর এ রকম করব না। স্যার বলে, তুই তো ক্লাসের ফার্স্ট বয়, তুই কেন এমন করলি? তাকে দুইটা কুইনাল ট্যাবলেট খেতে দিল। খাবার পর আবার মার। মারতে মারতে করিম স্যার দেখলাম পানি খেতে। তারপর শুরু করল ভূবনেশ্বর স্যার, তিনি মারতে মারতে আমাদের পাছা/পিঠ লাল করে দিয়েছে। এক সপ্তাহ মা আমার লাল জায়গায় তেল মালিস করে দিয়েছে আর কেঁদেছে। বলেছে, বাবা এরকম আর করো না। আমাদের সময়টায় শিক্ষকের প্রতি যেমন ভয় ছিল; তেমনি তাঁদেরকে আমরা শ্রদ্ধা করতাম, স্যাররা মারতো আমাদের ভালোর জন্য। দিন পাল্টাছে এখন আর স্কুলে বেত নাই। স্যাররা মারে না এমনকি কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে না বা উঠ-বস করায় না। দুঃখজনক এখন শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর মর্যাদা প্রবণতা কমে গেছে। এটা হওয়া উচিত না। পিতা-মাতার পরে শিক্ষকের স্থান। তাই বলবো সবাই শিক্ষককে সম্মান করবেন, আপনাদের ছেলে মেয়েদেরকে সম্মান করতে বলবেন।

৪১ বছর পর স্যার আমাকে চিনতে পেরেছে। দেখেই জড়িয়ে ধরলেন এবং অনেক কথা বললেন। পরে দুপুরের খাবার টেবিলেও অনেক কথা, স্যারের পারিবারিক কথা বললেন। আমার কাছে মনে হয়েছিল আমরা দুজন বন্ধু; অনেক দিন পর দেখা। স্যারকে আমার প্রকাশিত ২টি বই দিই। বইগুলো হাতে নিয়ে বললেন, তোর ছোট ভাইয়ের কাছে শুনেছি পিএইচডি করেছ, এখন দেখি তুই লেখালেখি করিস? ভালো অনেক ভালো, প্রার্থনা করি আরো বড় হও। স্যার আপনি অনেক ভালো মানুষ। আপনি ভালো ও সুস্থ থাকুন। বিধাতা আপনার সহায় হোক।

লেখক : ড. আব্দুস সাত্তার : ওয়াশিংটন ডিসি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়