বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, স্ত্রীর আত্মহত্যা
  •   ভারতকে কড়া বার্তা শ্রম উপদেষ্টার
  •   আধুনিক নৌ টার্মিনাল প্রকল্প পরিদর্শনে চাঁদপুরে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা
  •   ডাকাতিয়া নদী ও সিআইপি অভ্যন্তরস্থ খাল খননসহ ৫ দফা দাবিতে সংগ্রাম কমিটির সংবাদ সম্মেলন

প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৫

উদ্ভাবনী স্নাতক তৈরিতে উচ্চশিক্ষা কমিশন চাই

এম এম শহিদুল হাসান
উদ্ভাবনী স্নাতক তৈরিতে উচ্চশিক্ষা কমিশন চাই

বিশ্বে যে তিনটি শিল্পবিপ্লব হয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে রূপান্তরিত হয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের (১৯৪৭-২০০০) সময়। এখন আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আছি। অথচ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের সময়ের শিক্ষা পদ্ধতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যার আজও কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। কেন এমন হচ্ছে? স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়, যা সমাজকে সরকারের কাছে অর্থবহ পরিবর্তনের দাবি করতে অনীহা সৃষ্টি করে। ছাত্র ও শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে; যেখানে ব্যক্তিগত সুবিধাপ্রাপ্তি বিষয়ে অতিরিক্ত মনোযোগ ও কর্মজীবনে রাজনীতির ওপর নির্ভরতা শিক্ষার ব্যাপারে তাদের চিন্তাভাবনার সংকট তৈরি করে। বর্তমানে একটি কল্যাণকর, সমৃদ্ধ, উন্নতশীল বাংলাদেশ গড়ার কথা অনেকেই বলছেন। তবে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজন বিষয়ে তেমন কেউ বলছেন না। এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়টা ভিন্ন। এই যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য ভিন্ন ধরনের শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি করতে হবে। সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হলে সংশ্লিষ্টদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বৈশিষ্ট্যÑশারীরিক, ডিজিটাল ও জৈবিক জগতের সম্মিলন। যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অব থিংকস (আইওটি), ক্লাউড কম্পিউটিং এবং থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মতো উদীয়মান প্রযুক্তিগুলো ব্যাপক স্বয়ংক্রিয়তা চালিত করছে এবং বিভিন্ন খাতে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করছে। শিল্প খাতে স্মার্ট কারখানা এখন সাধারণ হয়ে উঠছে, যেখানে এআই এবং আইওটি মেশিনকে যোগাযোগ, স্ব-পর্যবেক্ষণ এবং রিয়েল-টাইমে অপ্টিমাইজেশনের সক্ষমতা প্রদান করে উৎপাদন দক্ষতা বাড়ায়। রোবটিকস আরও উন্নত হয়েছে, যা জটিল কাজের বৃহত্তর স্বয়ংক্রিয়তা সম্ভব করছে। ই-কমার্স মানুষকে যে কোনো স্থান থেকে অনলাইনে কেনাকাটার সুযোগ করে দিচ্ছে। এআই ডাক্তারদের আরও নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করতে পারে এবং ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহারকারীদের জন্য নির্দিষ্ট আর্থিক পরামর্শ দিতে পারে, যা এই সেবা আরও সহজলভ্য ও কার্যকর করে তোলে। এটি এমন এক যুগ, যেখানে রুটিন কাজ হারিয়ে যাচ্ছে এবং দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক সংযুক্তির কারণে ভবিষ্যতের কাজগুলোর ধরন অনুমান করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে পরিকল্পনা করব যেখানে চাকরির পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়? ভবিষ্যতের জন্য কী ধরনের গ্র্যাজুয়েট দরকার, যারা এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে? এটাই আজকের শিক্ষাক্ষেত্রের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জ।

যেহেতু প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে এবং ক্রমবিকাশমান আর অন্যদিকে আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী জ্ঞানের প্রয়োগ চালেঞ্জিং উচ্চশিক্ষিত সমাজ গঠনের তাগিদ দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি আলাদা ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আছে, যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য কৌশলগত তদারকি এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করা যায়।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ১৯৭২ সালে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়, যা কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। এর লক্ষ্য ছিল একটি নতুন জাতির প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ শিক্ষা কাঠামো তৈরি করা, যাতে পুরোনো ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজ ও অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো আরও ভালোভাবে পূরণ করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। যেমন– মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন (১৯৮৮), শামসুল হক কমিশন (১৯৯৭), জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি (২০০০) এবং কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন (২০০৯)। পরিতাপের বিষয়, কোনো শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবগুলো কার্যকর করা হয়নি এবং কমিশনগুলোও সমসাময়িক চাহিদা পূরণ করতে পারেনি।

বাংলাদেশে অনেকে শিক্ষাকে উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করার বিরোধিতা করেন। তারা মনে করেন, এই সংযোগ শিক্ষাকে শুধু একটি উপকরণে রূপান্তরিত করতে পারে, যা শুধু বস্তুগত প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যবহার হবে, যেন মানব উন্নয়ন একটি নির্মাণ প্রকল্পের মতো। তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষাকে মিলিয়ে দেখার ধারণা অগ্রহণীয় মনে করেন। তবে ইতিহাসের পাঠ হচ্ছে, শিক্ষা সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা ইঙ্গিত দেয় যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার স্বাধীনতা বজায় রেখে সমাজের প্রয়োজন ও চাহিদার প্রতি সাড়া দিতে পারে, নিজস্ব একান্ত পৃথিবীতে না থেকে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে, যে দেশগুলো উদ্ভাবন ও গবেষণাকে উৎসাহিত করে, তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত। উচ্চশিক্ষা কমিশন উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কৃষিশিক্ষা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং আন্তঃবিষয়ক অধ্যয়নের মতো অগ্রাধিকারমূলক তহবিলের ক্ষেত্র নির্ধারণ করে গবেষণাকে উৎসাহিত করতে পারে। একটি পদ্ধতি হতে পারে অন্তত তিনটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, যা কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এবং মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষায়িত হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার তরুণ প্রতিভাকে ব্যবহার করে স্থানীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক সমাধান তৈরি করতে এবং বৈশ্বিক অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত মডেল অনুসরণ করে আসছে। এই মডেল বলতে এমন একটি পদ্ধতির কথা বোঝায়, যা ফরাসি দার্শনিক রেনে ডেকার্টের কার্টেসিয়ান দর্শনের নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। শিক্ষাক্ষেত্রে এটি সাধারণত জটিল ধারণাগুলোকে সহজ উপাদানে ভাগ করার মাধ্যমে সমস্যা বোঝা এবং সমাধানের ধাপে ধাপে পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।

পক্ষান্তরে উচ্চশিক্ষায় নন-লিনিয়ার মডেল বলতে এমন একটি পদ্ধতির কথা বোঝায়, যা ঐতিহ্যবাহী, ধারাবাহিক এবং স্তরযুক্ত শিক্ষার পদ্ধতি থেকে সরে আসে। এই মডেল শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন শেখার পথ তৈরি করে দেয়, যেখানে তারা আন্তঃবিভাগীয় বিষয়গুলো অন্বেষণ, স্বনির্দেশিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও ক্যারিয়ার লক্ষ্য অনুযায়ী শিক্ষাকে মানিয়ে নিতে পারে। এই মডেল ঐতিহ্যগত ধারণা যে শেখার একটি নির্দিষ্ট ক্রম অনুসরণ করা উচিত, তা চ্যালেঞ্জ করে এবং তার পরিবর্তে আরও সমন্বিত ও প্রবহমান পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হয়। আরেকটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়, মানসিক বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান, সহানুভূতি এবং সহনশীলতার মতো অভিযোজনযোগ্য দক্ষতার জন্যও স্নাতকদের প্রস্তুত করতে হবে।

কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে এবং ২১ শতাব্দীর দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এসব সংস্কার সাবধানতার সঙ্গে করা উচিত, যাতে একটি টেকসই ও ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সময় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বজায় থাকে। সংস্কৃতি সমাজের ভিত্তি গঠন করে। উন্নতির পথে এগিয়ে চলার সময় এর মূল সত্তাকে অবহেলা করা উচিত নয়।

কমিশনের একটি প্রধান লক্ষ্য হবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষাকে সুলভ করা। কমিশনের প্রস্তাবনায় শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যবধান কমাতে, লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে এবং একাডেমিক সফলতার পথে আর্থিক বাধা অপসারণে সহায়ক হওয়ার বিষয়গুলো বিবেচনায় আসবে। একটি অরাজনৈতিক, দায়িত্বশীল এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে, উচ্চশিক্ষা কমিশন বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, উদ্ভাবন এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বে সাফল্যের জন্য প্রস্তুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়