বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫, ০০:৫৫

অনলাইন গেমে ডুবে যাচ্ছে সংসার-সময়।। বিপর্যস্ত পরিবার ও নতুন প্রজন্ম

তরুণ প্রজন্মের সাথে গেম খেলায় বেশি আসক্ত হচ্ছে প্রবাসীর স্ত্রীরাও, বাড়ছে পারিবারিক অস্থিরতা, স্বামী-সন্তানের প্রতি অনীহা ও বিচ্ছেদ, অডিও ভয়েস থেকে জড়াচ্ছেন অনৈতিক সম্পর্কে, রাত জেগে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

কবির হোসেন মিজি
অনলাইন গেমে ডুবে যাচ্ছে সংসার-সময়।। বিপর্যস্ত পরিবার ও নতুন প্রজন্ম
ছবি : সংগৃহীত

সারা বাংলাদেশের সাথে চাঁদপুরেও নতুন এক সামাজিক ব্যাধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে অনলাইন গ্রুপিং গেম এবং বিভিন্ন অ্যাপসের গেম। শহর থেকে শুরু করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও বর্তমানে এই সামাজিক ব্যাধির প্রবণতা ভয়ানকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এই অনলাইন গেমিংয়ে তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে আসক্ত হয়ে পড়ছেন অনেক মধ্যবয়সী নারীরাও। বিশেষ করে যাদের স্বামী প্রবাসে কিংবা কর্মব্যস্ত জীবনে পরিবারের অন্য সদস্যরা অনুপস্থিত। তারা দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোনে অনলাইন গেম খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংসার ও সময়। সংসার ভাঙ্গারও উপক্রম হচ্ছে অনেকের জীবনে।

প্রথমে তারা সময় কাটানোর জন্যে বিনোদন হিসেবে এই গেম খেলা শুরু করলেও এখন এটি হয়ে উঠছে সময় নষ্ট, পারিবারিক অস্থিরতা, এমনকি কারো কারো জীবনে সংসার ভাঙ্গনের কারণ। মানসিক অবসাদের উৎস হয়েও দাঁড়িয়েছে এই গেম।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি খেলা অনলাইন গেমগুলোর মধ্যে রয়েছে : পাবজি, ফ্রি ফায়ার, মোবাইল লেজেন্ডস, লুডু কিং, ক্যান্ডি ক্রাশ, কয়েন মাস্টার, গাচা লাইফ ইত্যাদি। এসব গেমের কিছুতে রাতভর ‘ব্যাটল’ বা যুদ্ধধর্মী খেলা চলে, আবার কিছু গেমে ভার্চুয়াল কয়েন বা চরিত্র কেনাবেচার মাধ্যমে গেমারদের অর্থব্যয়ও করতে হয়।

অডিও ভয়েস চ্যাট সুবিধার কারণে নারী-পুরুষ এক সাথে গেম খেলার সময় অপরিচিতদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, যা ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। এই ধারা থেকে অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন অনৈতিক সম্পর্কে, যার পরিণতি হচ্ছে পারিবারিক অশান্তি ও বিচ্ছেদ।

বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে খবর নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান সময়ের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উঠতি বয়সী তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি অনেক প্রবাসী পরিবারের নারীরা গেম খেলার নামে ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপে যুক্ত হয়ে গেম খেলার সাথে অডিও ভয়েস চ্যাটে কথা বলেন।

এভাবে নিয়মিত দিনের পর দিন গেম খেলতে খেলতে তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠে অচেনা পুরুষদের সঙ্গে, যা এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। যার কারণে সংসারে বাড়ে অশান্তি।

স্বামী, সন্তান কিংবা পরিবারের শ্বশুর শাশুড়ির সাথে খারাপ আচরণ করতে শুরু করেন গেম খেলায় আসক্ত নারীরা। এই আসক্তির প্রভাব শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়, অনেক নারী এখন সন্তানদের উপেক্ষা করে গেমে নিমগ্ন থাকেন।

খাবার, লেখাপড়া, ঘুম সব কিছুতেই খামখেয়ালিপনা বাড়ছে। শিশুরা মায়ের মোবাইল ব্যবহারের এই ধারা অনুকরণ করে নিজেরাও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তৈরি সম্পর্কের ফলে অনেক নারী সামাজিকভাবে অপমানের শিকার হচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে ব্ল্যাকমেইল, মানহানি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার ঘটনাও ঘটেছে।

জেলার বিভিন্ন স্থানে খবর নিয়ে জানা গেছে, একাধিক পরিবারে দেখা গেছে অনলাইন গেমকে কেন্দ্র করে দাম্পত্য কলহের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিষয়টি বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়িয়েছে।

প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে চলা সংসারে যদি ভালোবাসা আর সম্মান না থাকে, তাহলে সেই সংসার দীর্ঘস্থায়ী হয় না, এ কথা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন গেমে অতিরিক্ত আসক্তি ‘ডিজিটাল ড্রাগ’-এর মতো কাজ করে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতের ঘুম পর্যন্ত অনেক নারী এখন মোবাইলে লুডু, পাবজি, ফ্রি ফায়ার, ক্যাসিনো টাইপ গেম কিংবা ফেইসবুক গেমস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এতে করে সংসার, সন্তান, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অনীহা তৈরি হচ্ছে

চাঁদপুর শহরের বিভিন্ন এলাকাসহ সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর, বালিয়া, ফরক্কাবাদ, চান্দ্রা, রামপুর, ফরিদগঞ্জ, পুরাণবাজারসহ বেশ কিছু এলাকায় অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, প্রবাসীদের স্ত্রীরা দীর্ঘ সময় একা থাকার কারণে একঘেঁয়েমি দূর করতে অনলাইন গেমে আসক্ত হচ্ছেন।

কেউ কেউ আবার গেম খেলতে খেলতেই পরিচিত হচ্ছেন অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে, যা থেকে জন্ম নিচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন।

এক স্কুল শিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “একসময় মোবাইল ছিলো যোগাযোগের মাধ্যম। এখন সেটাই হয়ে উঠছে বিরোধ ও বিচ্ছেদের কারণ।”

“আমার এক আত্মীয় সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত মোবাইলে লুডু খেলেন। স্বামী প্রবাসে, বাচ্চা স্কুলে--এই সময়টুকু তিনি কাটান গেমেই। দিন দিন সে মানসিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।”

চাঁদপুরের বেশ ক'জন চিকিৎসকের সাথে এ বিষয়ে আলাপকালে তারা বলেন, এই গেম আসক্তি এক ধরনের মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে। এতে মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা বেড়ে যায়, যার ফলে মানুষ বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

দীর্ঘ সময় গেম খেললে মাথাব্যথা, ঘুম কমে যাওয়া, মনোযোগের অভাবসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়।

অনলাইন গেমের কারণে অনেক ক্ষেত্রে পরিবারে অশান্তি, দাম্পত্য টানাপোড়েন এমনকি সন্তানদের প্রতি অবহেলা বাড়ছে। বিভিন্ন জায়গায় অথবা চায়ের দোকানের আড্ডায় এ বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও এখনো নেই কোনো সচেতনতামূলক উদ্যোগ বা প্রশিক্ষণ।

সামাজিক ও পারিবারিক বিশ্লেষকগণ বলছেন, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। অনলাইনে নারীদের প্রোডাক্টিভ কাজ যেমন হস্তশিল্প, অনলাইন ব্যবসা কিংবা ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকেও দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন।

মোবাইল-ইন্টারনেট যদি সঠিকভাবে ব্যবহার না করা হয়, তবে এটি আশীর্বাদ নয়, হয়ে উঠবে সমাজের এক বড়ো অভিশাপ।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়