প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
ঘটনাস্থল হাজীগঞ্জ
১৯ হাজার শিক্ষার্থীর প্রশ্নপত্র নিয়ে ব্যবসা করছে কারা?
স্বাভাবিক বাজার দর হিসেবে প্রশ্ন তৈরিতে সেট প্রতি খরচ পড়ে সাড়ে ৫ টাকা থেকে ৬ টাকা। বিষয় বেশি হলে সেই প্রশ্নের সেট তৈরিতে খরচ পড়ে ১০/১১ টাকা। এখানে ৬ টাকার স্থলে নেয়া নেয়া হচ্ছে ১০ টাকা আর ১০/১১ টাকার স্থলে নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। পরীক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার। সেই হিসেবে সেট প্রতি বাড়তি নেয়া টাকার অঙ্কটা মোটেই কম নয়। এই পুরো টাকাটা আবার দিতে হচ্ছে বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকদের পকেট থেকে। তবে বিদ্যালয়ের স্লিপের বরাদ্ধ এলে সেখান থেকে উক্ত টাকা ফেরত দেয়া হবে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রশ্ন তৈরিকারী দায়িত্বরত শিক্ষকরা বলছেন, সহকারী শিক্ষা অফিসার (এটিও)-এর তত্ত্বাবধানে আমরা কাজ করছি তারা বলছেন অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের হাতে। তবে এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ।
|আরো খবর
খোঁজ নিয়ে জানা য়ায়, গত ২১ আগস্ট (সোমবার) হাজীগঞ্জের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ২য় প্রান্তিক মূল্যায়ন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। উক্ত শ্রেণিগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রাথমিক অধিদপ্তরের দেয়া নিয়মে। সেই নিয়মকে ঠিক রেখে একটু ভিন্নভাবে কথিত বাণিজ্যে মেতেছে দায়িত্বরত বহুজন। যার দায়ভার কেউ নিতে চাইছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাজীগঞ্জ উপজেলার ৬টি ক্লাস্টারে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে একজন করে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিও) দায়িত্ব পালন করছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দেয়া নিয়মে দায়িত্বপ্রাপ্ত এটিওগণের মাধ্যমে ২য় প্রান্তিক মূল্যায়নের প্রশ্ন তৈরি, কম্পোজ করা, প্রুফ করা, প্যাকেট করা, নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করছেন ক্লাস্টারভিত্তিক শিক্ষক টিম। এই টিম থেকে সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের বিদ্যালয়গুলো নগদ টাকায় প্রশ্নের সেট কিনে নিয়েছে। পুরো ব্যবস্থাপনাকে দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করার কথা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার।
হাজীগঞ্জের একাধিক ক্লাস্টারে খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সাথে মুঠোফোনে কথা বলে জানা যায়, ক্লাস্টারগুলোর মধ্যে ২য় শ্রেণির প্রতি সেট প্রশ্নের দাম ধরা হয়েছে ১০ টাকা। ৩য় শ্রেণি থেকে শুরু করে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত সকল ক্লাসের প্রশ্নের সেটের দাম ধরা হয়েছে ২০ টাকা। তবে সদর ক্লাস্টারের সেট প্রতি প্রশ্নের দাম কিছু কম নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক।
প্রশ্ন তৈরির দায়িত্বরত সদর ক্লাস্টারের শিক্ষক তাজুল ইসলাম জানান, টাকার লেনদেনের সাথে আমি জড়াইনি। তাই সেট প্রতি কতো টাকা নেয়া হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে আমি জেনে জানাবো বলে পরে আর কোনো তথ্য জানাননি তাজুল ইসলাম।
পালিশারা ক্লাস্টারের প্রশ্ন তৈরির নেতৃত্বদানকারী শিক্ষক সরোয়ার আলম জানান, আমরা ২য় শ্রেণির প্রশ্নপত্র ১০ টাকা আর ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ২০ টাকা করে নিয়েছি। সেট তৈরি খরচের চেয়ে দাম বেশি কেনো নেয়া হলো সে বিষয়ে এই শিক্ষক বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই কাজ করেছেন তিনি।
বাকিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রওশন আরা জানান, আমরা ২য় শ্রেণির প্রশ্নপত্র ১০ টাকা আর ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণির প্রতি সেট প্রশ্ন ২০ টাকা দরে কিনেছি।
রামচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথিমক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খোরশেদ আনোয়ার জানান, নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে এনেছি। এর বাইরে কিছু বলতে পারবো না। বেশি কিছু জানতে চাইলে স্যারদের সাথে কথা বলেন।
রান্ধুনীমুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আছিয়া খাতুন জানান, ১৭৭০ টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে এনেছি।
এ বিষয়ে সহকারী শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, প্রশ্ন তৈরিসহ সব বিষয় ক্লাস্টারভিত্তিক শিক্ষক টিম কাজ করেছেন। সব কিছুই তাদের হাতে। আমরা দেখাশোনা করেছি মাত্র।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবু বকর তফদার জানান, চলিত বছরের শুরুতে আমরা ১ম প্রান্তিক মূল্যায়ন পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করে পরীক্ষা নিয়েছি। তখন ২য় শ্রেণির প্রশ্নের সেট তৈরিতে আমাদের খরচ হয়েছে সাড়ে ৫ টাকা থেকে ৬ টাকা। ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি সেট তৈরি করেছি ১০/১১ টাকা। এখন কেন এতো বেশি টাকা নেয়া হয়েছে এ নিয়ে আমি মিটিংয়ে কথা বলেছি। এ নিয়ে এটিও স্যারা কোনো উত্তর দেননি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, পুরো প্রশ্নের সেট এখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগণকে নিজেদের টাকায় কিনে নিতে হয়েছে। বলা হয়েছে স্লিপের বরাদ্দ আসলে সেটা ফেরত দেয়া হবে। টাকাও বেশি নেয়া হলো আবার স্লিপ বরাদ্দ কবে আসে তার কোন ঠিক নাই, এটা কেমন জুলুম?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষকনেতা জানান, প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১৯ হাজার সেট প্রশ্ন থেকে ৫টাকা আর ৮/১০ টাকা করে বেশি নেয়া হলে ব্যবসা হিসেবটা কোথায় দাঁড়ায়? স্লিপের ফান্ড মানে টাকাটা তো সরকারি। সরকারি চাকুরি করে সরকারি টাকার তছরূপ করার সাহস পায় কোথায় এরা?
হাজীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আবু সাইদ চৌধুরী বলেন, সহসায় স্লিপের বরাদ্দ আসলে তা ছাড় দিয়ে দেয়া হবে। প্রশ্নের সেট তৈরির খরচ আর বিদ্যালয়গুলো থেকে সেট প্রতি টাকার হেরফেরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব কিছু তো শিক্ষকরা করেছেন। আমরা তা দেখাশোনা করেছি মাত্র। যদি কোন হেরফের হয় তাহলে তা খতিয়ে দেখা হবে।