প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:৪২
চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাবের ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে সাক্ষাৎকার-২
চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাব নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণার বাতিঘর
-------সাবেক সভাপতি উজ্জ্বল হোসাইন

চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাবের ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। ক্লাবের সাবেক সভাপতি হিসেবে আমি গর্বের সাথে বলতে পারি, এই ক্লাব শুধু সমাজসেবার কাজই করেনি, বরং অসংখ্য তরুণের জীবনে নেতৃত্ব, মানবতা ও দায়িত্ববোধের শিক্ষা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে রোটার্যাক্ট ক্লাব বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম— রক্তদান, শিক্ষা সহায়তা, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি ও যোগাযোগের অগ্রগতিতে ক্লাবটি আরও সক্রিয় ও আধুনিক রূপ পেয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, এই অর্ধশতাব্দীর সাফল্য আমাদের আগামীর দিকনির্দেশনা। তরুণ প্রজন্ম রোটার্যাক্টের মূল্যবোধ 'সেবাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম' বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে আমরা চাই চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাব হোক নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব বিকাশের কেন্দ্র, যেখানে মানবিকতা, উদ্ভাবন ও সমাজসেবার সমন্বয় ঘটবে। এই ৫০ বছর আমাদের অনুপ্রেরণা, আর আগামীর পথ চলায় আমাদের দায়িত্ব।
|আরো খবর
চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাবের ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন ক্লাবটির সাবেক সভাপতি উজ্জ্বল হোসাইন। ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার পর্বে
ক্লাবের ইতিহাস, সাফল্য, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও মানবিক কাজ সম্পর্কে চাঁদপুর কণ্ঠের মুখোমুখি হন রোটা. উজ্জ্বল হোসাইন। তাঁর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কাজী আজিজুল হাকিম নাহিন। প্রশ্নোত্তর আকারে নিচে সেটি তুলে ধরা হলো :
চাঁদপুর কণ্ঠ : চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাবের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে আপনাকে স্বাগত জানাই। কেমন লাগছে এই বিশেষ মুহূর্তে?
উজ্জ্বল হোসাইন : চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের যুব সংগঠন চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাব ৫০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যাচ্ছে, যা ভাবতে সত্যি অবাক লাগছে। ক' বছর আগে অভিভাবক ক্লাব চাঁদপুর রোটারী ক্লাবও এ মাইলফলক অতিক্রম করেছে। একটি সংগঠন টিকে থাকে শক্তিশালী নেতৃত্বের মাধ্যমে। তেমনি চাঁদপুরের এই ক্লাবটিও সূচনালগ্নের পর থেকে করিৎকর্মা নেতৃত্বের মাধ্যমে ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। যেটি আমি এই ক্লাবের একজন সাবেক সভাপতি হিসেবে আমার হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। এটি এক সময় শতবর্ষ অতিক্রম করবে--এই প্রত্যাশা রাখছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনি কীভাবে এ ক্লাবের সাথে যুক্ত হলেন?
উজ্জ্বল হোসাইন : 'বন্ধুত্বের মাধ্যমে সেবা' এই স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে আমি ২০০৮ সালে এই ক্লাবে সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত হই। সে বছরই আমাদের এ ক্লাবটি সারা বাংলাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ক্লাব হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। তখন ক্লাবের সভাপতি ছিলেন চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের বর্তমান সেক্রেটারি নাজিমুল ইসলাম এমিল ও সেক্রেটারি ছিলেন মানিক কর্মকার। সূচনালগ্নে ক্লাবের এই প্রাপ্তিতে আমার প্রত্যাশা অনেক গুণ বেড়ে যায়। তখনই মনে মনে চিন্তা করি, কবে আমি এই ক্লাবের সভাপতি হবো। পর্যায়ক্রমে ২০১৩-১৪ রোটারী বর্ষে আমি এই ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : এই ক্লাব আপনার জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? আপনি কি উপকৃত হয়েছেন?
উজ্জ্বল হোসাইন : চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের যুব সংগঠন রোটার্যাক্ট ক্লাবের মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলি, নেতৃত্ব দেয়ার কৌশল, সাংগঠনিক মনোভাব ও সত্যিকারের একজন লিডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। রোটারীর মূলমন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করে আমি আমার ব্যবসা ও পেশাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পেরেছি। যার ফলে আমি আমার কর্মস্থল চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালে সেরা কর্মকর্তা ও বিশেষ সম্মাননা পেয়েছি। আমি জীবনে চেষ্টা করি রোটারীর মূলমন্ত্র 'সেবা স্বার্থের ঊর্ধ্বে' এটিকে পুরোপুরি মেনে চলতে। তাই চাঁদপুরে রোটারী ক্লাবের মতো এতো বড় সংগঠনে ২০২৩-২০২৪ রোটারী বর্ষে সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছি। এছাড়াও রোটারীর মাধ্যমে নেতৃত্ব বিকাশে শিক্ষা নিয়ে চাঁদপুরে বহু সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছি। যেটি আমাকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাব নিয়ে কোন্ বিষয়টি গর্বের মনে হয় আপনার কাছে?
উজ্জ্বল হোসাইন : আমার গর্বের জায়গা হলো, এই ক্লাবের সদস্যরা বর্তমানে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের নেতৃত্ব দিচ্ছে। কারণ ছোট থেকেই এই ক্লাব নেতৃত্ব বিকাশের গুণাবলি শিক্ষা দিচ্ছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার জানা মতে, গত ৫০ বছরে চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানবিক প্রকল্পগুলো কী কী? কোন্ প্রকল্পটি সমাজে সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়?
উজ্জ্বল হোসাইন : চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের যুব সংগঠন চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাব সবসময় রোটারীর কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। রোটারীর সব সেবামূলক প্রকল্পে চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাবের সদস্যদের উপস্থিতি প্রকল্পগুলোকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নে সহায়তা করে। এই ক্লাবের দাতব্য চিকিৎসালয় প্রকল্পটি একটি মাইলফলক, যা ক্লাবের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ০-১২ বছরের শিশুদের সাপ্তাহিকভাবে চিকিৎসা সেবা ও ও বিনামূল্যে ঔষধ দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও চাঁদপুর রোটারী ক্লাব ও চাঁদপুর রোটার্যাক্ট ক্লাবের মাধ্যমে একজন অসহায় ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিবছর চক্ষু চিকিৎসা শিবির, কর্মহীন মানুষকে সহায়তা, শিক্ষাবৃত্তি প্রকল্পে সত্যিই কিছুটা হলেও সমাজের মানুষ সহযোগিতা পাচ্ছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : স্থানীয় যুবকদের সমাজসেবায় যুক্ত করতে ক্লাবটি কীভাবে ভূমিকা রাখছে?
উজ্জ্বল হোসাইন : আমাদের তরুণ সমাজ যেখানে নানাবিধ নেশায় আসক্ত, সেখানে ক্লাবের মাধ্যমে তরুণদেরকে একীভূত করে নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা করছে, এতে করে তরুণরা অন্য কোনো নেশায় আসক্ত না হয়ে এই ক্লাবের মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তারা জীবনের শুরুতেই চিন্তা করতে শিখে, নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যে কীভাবে মানুষকে সেবা দেয়া যায়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আগামী ৫ বা ১০ বছরে ক্লাবকে কোথায় দেখতে চান?
উজ্জ্বল হোসাইন : এই মুহূর্তে একটাই কামনা করি, আরো বেশি তরুণ সমাজকে ক্লাবে অন্তর্ভুক্ত করে সমাজের নানা অনাচার থেকে রক্ষা করা। তবে আমি আবারও বলছি, এই ক্লাব একদিন শতবর্ষ অতিক্রম করবে, সেদিন হয়তো আমরা থাকবো না, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ক্লাবের কার্যক্রম সচল রাখবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্বে আনতে কী ধরনের পরিকল্পনা থাকা দরকার বলে মনে করেন?
উজ্জ্বল হোসাইন : রোটার্যাক্ট ক্লাব সমাজসেবা ও নেতৃত্ব বিকাশের অন্যতম আন্তর্জাতিক সংগঠন। নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্বে আনতে হলে ক্লাবের পরিকল্পনা হতে হবে দূরদর্শী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রেরণাদায়ক। প্রথমত, তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রোটার্যাক্ট ও ইন্টার্যাক্ট ক্লাব গঠন জরুরি। এতে তরুণরা মানবসেবা, দলগত কাজ ও নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। দ্বিতীয়ত, নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে তাদের আত্মবিশ্বাস ও যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, ডিজিটাল যুগের প্রয়োজন বিবেচনায় অনলাইন নেতৃত্ব কর্মসূচি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। এছাড়া রোটারী ক্লাবের প্রবীণ সদস্যদের অভিজ্ঞতা তরুণদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার একটি মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম গড়ে তোলা উচিত। সর্বোপরি তরুণদের সামাজিক সমস্যার সমাধানমূলক প্রকল্পে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ দিলে তারা বাস্তব জীবনে দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্বগুণে সমৃদ্ধ হবে। এভাবেই রোটারী ক্লাব নতুন প্রজন্মকে দক্ষ, মানবিক ও উদ্ভাবনী নেতৃত্বে পরিণত করতে পারে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সমাজের কিশোর-তরুণদের জন্যে আপনার বার্তা কী হবে?
উজ্জ্বল হোসাইন : সমাজের কিশোর ও তরুণরাই ভবিষ্যতের নেতৃত্বের মূল ভিত্তি। তাদের উদ্দেশে বলবো, তোমাদের হাতেই নির্ভর করছে আগামী দিনের বাংলাদেশ—একটি শিক্ষিত, মানবিক ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের স্বপ্ন। তাই প্রথমে নিজেকে জানো, নিজের সামর্থ্য ও দুর্বলতা বুঝে তা উন্নত করার চেষ্টা করো। শিক্ষাকে শুধু পুঁথিগত জ্ঞানে সীমাবদ্ধ না রেখে মানবিকতা, সততা ও দেশপ্রেমে রূপান্তরিত করো। সামাজিক মাধ্যম ও প্রযুক্তিকে বিনোদনের জন্যে নয়, জ্ঞান ও ইতিবাচক চিন্তাধারার বিস্তারের জন্যে ব্যবহার করো। অন্যের সাফল্যে হিংসা নয়, অনুপ্রেরণা খুঁজে নাও। মনে রাখবে, ব্যর্থতা কোনো শেষ নয়—বরং নতুনভাবে শুরু করার শিক্ষা। মাদক, সহিংসতা ও নেতিবাচক প্রভাব থেকে দূরে থেকে তোমার সময়, প্রতিভা ও শক্তি সমাজের কল্যাণে ব্যয় করো। ছোট ছোট কাজের মধ্য দিয়েই বড়ো পরিবর্তন আসে—এ বিশ্বাস রাখো। একদিন তোমরাই দেশের নেতৃত্বে আসবে, তাই এখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করো নৈতিকতা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে। তোমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে আগামীর বাংলাদেশ।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আজকের তরুণ প্রজন্মকে রোটার্যাক্টে যুক্ত হতে আপনি কীভাবে উৎসাহ দেবেন?
উজ্জ্বল হোসাইন : খারাপ নেশায় আসক্ত না হয়ে রোটারীর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আসুন সমাজকে পরিবর্তন করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনাকে অনেক প্রশ্ন করলাম। এ প্রশ্নমালার বাইরে আপনার আর কিছু বলার আছে কি?
উজ্জ্বল হোসাইন : আজকের তরুণ প্রজন্ম শক্তি, উদ্যম ও পরিবর্তনের প্রতীক। এই তরুণদের সমাজ গঠনের মূলধারায় যুক্ত করতে রোটার্যাক্ট হতে পারে একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্ম। আমি তাদের বলবো—রোটার্যাক্ট শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি আত্মোন্নয়নের একটি স্কুল। এখানে তুমি শেখবে নেতৃত্ব, দলগত কাজ, মানবসেবা ও নৈতিক দায়িত্ববোধ। রোটার্যাক্টে যুক্ত হলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবে, যা তোমার চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মবিশ্বাসকে প্রসারিত করবে। সমাজের দরিদ্র, অসহায় ও পিছিয়েপড়া মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃত মানবিকতার আনন্দ অনুভব করতে পারবে। এছাড়া রোটার্যাক্ট আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত একটি নেটওয়ার্ক, যেখানে বিশ্বজুড়ে তরুণদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে। এটি তোমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠবে। তাই আমি তরুণদের বলবো—রোটার্যাক্টে যুক্ত হও, নিজেকে গড়ো, সমাজকে বদলাও। কারণ প্রকৃত নেতৃত্ব শুরু হয় সেবার মাধ্যমে।








