শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে 'আল্লাহু চত্বর'
  •   চাঁদপুর কণ্ঠৈর কলামিস্ট এএসএম শফিকুর রহমানের ইন্তেকাল
  •   নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পেল সেনাবাহিনী
  •   জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ প্রধান উপদেষ্টার ১০০ কোটি টাকার অনুদান
  •   মেঘনায় নিখোঁজ দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২১, ২০:৪৭

ব্যবসা জগতে এক জীবন্ত কিংবদন্তী

দেশসেরা করদাতা দানবীর হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার ৯২তম জন্মদিন ২৬ আগস্ট

স্টাফ রিপোর্টার
দেশসেরা করদাতা দানবীর হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার ৯২তম জন্মদিন ২৬ আগস্ট

বাংলাদেশে তাঁকে বলা হয় দানবীর। যিনি মানবতার সেবকের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তিনি মানবিকতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। সৎভাবে ব্যবসা করে দেশের শ্রেষ্ঠ করদাতার খ্যাতি পেয়েছেন অনেক। তিনি হচ্ছেন চাঁদপুরের কৃতী সন্তান, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যবসায়ী হাজী মোহাম্মদ কাউছ মিয়া। ২৬ আগস্ট গুণী এ মানুষটির জন্মদিন।

১৯৩১ সালের এই দিনে কাউছ মিয়া চাঁদপুর সদর উপজেলার রাজরাজেশ^রে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাজী আব্বাস আলী মিয়া ও মাতা মরহুমা হাজী মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন (জমিদার কন্যা)। ৯১ তম বছর শেষ করে ৯২ বছরে পা রাখলেন কাউছ মিয়া। বয়স একানব্বই পার হলেও তিনি এখনো প্রাণবন্ত। কাউছ মিয়া মনে করেন, মানুষ যদি শরীর ও মনের দিক থেকে সুস্থ থাকে, সেটি আল্লাহর নেয়ামত। আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ সুস্থ থাকতে পারে না।

তিনি বলেন, রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া, আল্লাহ আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন। এখনো প্রতিদিন তিনি ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা নিজেই ব্যবসা পরিচালনা করেন। ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টানা ৭১ বছর এককভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে অর্জন করেছেন স্বাধীনতার আগে এবং পরে সিআইপি মর্যাদার সর্বাধিক ১৮বার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরেও ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে দেশসেরা করদাতার ১ নাম্বার মনোনীত হয়ে ট্যাক্সকার্ড ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২১ সালে মুজিববর্ষের সেরা চমক ছিলেন কাউছ মিয়া। কেননা তিনি মুজিববর্ষে সারা বাংলাদেশের মাত্র একজন শ্রেষ্ঠ করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কর প্রদানে সততা, আন্তরিকতা ও স্বপ্রণোদনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে জাতীয় রাজস্ব খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় দেশসেরা করদাতার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।

গুলশান-বনানী, মতিঝিলের ডাকসাইটে ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে পুরাণ ঢাকার ঘুপচি গলির এই ব্যবসায়ীই প্রতি বছর সর্বোচ্চ করদাতা হন। প্রতিবারই শীর্ষ করদাতাদের তালিকায় তাঁর নাম থাকছে সবার উপরে। অবশ্য অন্য শ্রেণির ব্যবসায়ীগণ প্রতিবছর সর্বোচ্চ যে পরিমাণ টাকার কর দেন, কাউছ মিয়ার ধারে কাছেও নেই তারা।

হাজী মোহাম্মদ কাউছ মিয়া তাঁর ৯২তম জন্মদিনে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করেন এবং সকলের কাছে দোয়া কামনা করেছেন। প্রবীণ এই মানবসেবকের শুভ জন্মদিনে তাঁকে চাঁদপুর ও শরীয়তপুরবাসীর পক্ষ থেকে নিরন্তর ভালোবাসা এবং ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানো হয়েছে।

কাউছ মিয়া ৬৪ বছর ধরে কর দিয়ে আসছেন। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দেন তিনি। কেনো কর দেয়া শুরু করলেন, এর ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। ২০১৯ সালে এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আগে টাকা-পয়সা এখানে-সেখানে রাখতাম। এতে নানা ঝামেলা ও ঝুঁকি থাকতো। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দিয়ে ‘ফ্রি’ হয়ে গেলাম। এরপর সব টাকা-পয়সা ব্যাংকে রাখতে শুরু করলাম। হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার করে রাখলাম।’

১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন কাউছ মিয়া। তাঁর বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে নামেন। বাবার ইচ্ছা ছিলো ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। অথচ ব্যবসায় মন পড়ে থাকা কাউছ মিয়া ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামায় আর পড়াশোনা এগোয়নি। পুরাণবাজার মধুবাবুর স্কুলে পড়েছেন তিনি। ওই স্কুলের পাশেই তাঁর নানা জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম সাহেবের বাড়ি। কাউছ মিয়া তাঁর বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরাণবাজারে স্টেশনারী ব্যবসা দেন। দেশের প্রসিদ্ধ এই বাণিজ্যিক এলাকায় তৎকালীন সময় ক্রমশ তার ৬টি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এরপর ধীরে ধীরে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন তিনি। পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এবং তামাকসহ অন্যান্য ব্যবসা শুরু করেন। ৪০ থেকে ৪২ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত (তৎকালীনসহ বিভিন্ন সময়ে)।

একবার কাউছ মিয়া আমদানির ব্যবসায় নামতে লাইসেন্স নিয়েছিলেন। এ ব্যবসায় কারসাজি না করলে টিকে থাকা মুশকিল, এটা চিন্তা করে আমদানির ব্যবসা করেন নি। নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্যে বেশ কিছু কার্গো জাহাজ রয়েছে কাউছ মিয়ার। জাহাজগুলো ছেলেদের নামে, তারাই এই ব্যবসা দেখাশোনা করছেন।

হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার বড় বাবার নাম হাজী মোঃ মুসলিম মিয়া বেপারী, দাদার নাম হাজী মোঃ সবদ আলী মিয়া বেপারী (সবদ হাজী)। পিতার নাম হাজী মোঃ আব্বাস আলী মিয়া বেপারী ও মাতা জমিদার কন্যা মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন। তাঁরা কেউ বেঁচে নেই। তাঁদের বাড়ির বেশ নামডাক ছিলো। এক নামে হাজী বাড়ি হিসেবে চিনত সবাই। তাঁর দাদারা ছিলেন ৬ ভাই। তাঁরা পায়ে হেঁটে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন। তখন হজ্বে যেতে সময় লাগতো ৬ মাস, এখন সময় লাগছে ৬ ঘণ্টা।

কাউছ মিয়ার বড়বাবা অর্থাৎ নানার পিতা আজগর দেওয়ান। তিনি ছিলেন সতেরশ’ সালের ত্রিপুরা ডিস্ট্রিক্টের প্রতাপশালী জমিদার। আজগর দেওয়ানের ৭ ছেলে ও ১ মেয়ে। উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলেমেয়ে আটজনই ছিলেন জমিদার। আজগর দেওয়ানের কনিষ্ঠ পুত্র জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম। ১৮৬৫ সালে তিনি কোলকাতা আলীগড় বিশ^বিদ্যালয় থেকে টাইটেল পাস করেন।

কাউছ মিয়া তাঁর ব্যবসায়িক জীবনে কখনো কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তির নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করেন নাই। তাঁর বাপদাদারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি। এমনকি পূর্ব পুরুষদের কেউ রাজনীতি করেন নি। এ জন্যে কাউছ মিয়া এবং তাঁর ছেলেরাও কোনো রাজনীতি করেন না।

একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সবসময় নিজেকে সমাজসেবা ও মানবসেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু মানুষকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর এক চাচাতো ভাই রুস্তম আলী বেপারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জ আইটি স্কুলের সামনে পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশবাসী হাজী কাউছ মিয়াকে একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবেই চিনেন। তিনি তাঁর মরহুম পিতার নামে উত্তর তারাবুনিয়া আব্বাস আলী উচ্চ বিদ্যালয় এবং চাঁদপুর শহরের স্ট্র্যান্ড রোডে (কবি নজরুল সড়কে) মায়ের নামে ফাতেমা খাতুন মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি চাঁদপুর গুয়াখোলা আবাসিক এলাকায় মদিনা জামে মসজিদ এবং স্ট্র্যান্ড রোডে (বর্তমান কবি নজরুল সড়কে) আল-আমিন স্কুলের পাশে বোগদাদীয়া জামে মসজিদ গড়ে দিয়েছেন। এ দুটি মসজিদের মোতওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

তিনি বলেন, আমি ১৯৫৮ সাল থেকে কর প্রদান করে আসছি। ১৯৬৭ সালে আমাকে তৎকালীন সরকার ১নং করদাতার সার্টিফিকেট প্রদান করেন। আমি ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসি। তখন তামাকসহ বিভিন্ন মালামাল কেনাবেচা এবং মালামাল গুদামজাত করে ব্যবসা করছি। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্য তিনি মজুত করে ব্যবসা করেননি।

দেশসেরা এই করদাতা আরও জানান, ১৯৮৮ সালে তিনি হাকিমপুরী জর্দা তৈরি এবং বাজারজাত করেন। তখন এটি ছিলো কুটির শিল্প। তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৪/৫ জন শ্রমিক কাজ করতো। সরকার ১৯৯৯ সালের জুন মাসে জর্দার উপর ভ্যাট আরোপ করে। তখন বছরে ট্যাক্স প্রদান করতেন ৩০/৩৫ হাজার টাকা। বর্তমানে সম্পূরক শুল্কসহ ট্যাক্স প্রদান করছেন প্রায় ৮/৯ কোটি টাকা। বর্তমানে জর্দা ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাঁর ঢাকাতে অনেক বাড়িঘর, জায়গা-জমি রয়েছে। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদপুরে নিজস্ব জমিতে কৃষিপণ্য চাষাবাদ করে ফলন করছেন। এর সাথে ৩টি বড় গরুর খামার রয়েছে। সেখানে তাঁর খরিদকৃত হাজার হাজার বিঘা জমি রয়েছে। হাজী মোঃ কাউছ মিয়া ৭ জমিদারের নাতি। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি নানাদের জমিদারি সম্পত্তির অংশ পাবার নিয়ম থাকলেও সেই সম্পত্তি নেন নি এবং তাঁর পূর্ব পুরুষরাও শ^শুর বাড়ির সম্পত্তি এবং তাঁর ছেলেরাও নেন নি। বাংলাদেশের শীর্ষ করদাতার সর্বাধিক পুরস্কার লাভ করায় এবং সর্বশেষ মুজিব শতবর্ষের সেরা করদাতার বিরল রেকর্ডের অধিকারী হওয়ায় চাঁদপুরবাসী তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করছে। একের পর এক সাফল্যে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় দানবীর কাউছ মিয়ার নাম। অনেকে বলেন, সত্যিই ব্যবসা জগতে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী।

মানব সেবার দৃষ্টান্ত--- ১৯৫৪ সাল থেকে এ যাবৎ ২২ বার দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। দেশের যে প্রান্তেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন, পাহাড়ধস হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে যখন বৈশ্বিক করোনা মহামারি দেখা দেয় তখনসহ প্রতিটি দুর্যোগে তিনি বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ-সাহায্য দিয়েছেন।

১৯৮৮-এর ভয়াবহ বন্যার সময় টানা একমাস, ১৯৯৮’র বন্যার সময় প্রায় দুই মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে পানিবন্দী মানুষের দোরগোড়ায় রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়ে কাউছ মিয়া দেশ-বিদেশে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ২০২০ সালে মানুষ যখন মরণব্যাধি করোনাভাইরাসে দিশেহারা, এ সময়েও প্রায় ৭/৮ কোটি টাকার ত্রাণ সহায়তা দিয়ে মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এভাবেই চব্বিশ বছর বয়স থেকে ৬৭ বছর যাবৎ মানবসেবা করে যাচ্ছেন হাজী মোঃ কাউছ মিয়া।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়