শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৩, ০০:০০

বিশ্বের মুক্তিকামী কণ্ঠস্বর মিলেছিল এক মোহনায়
অনলাইন ডেস্ক

যুদ্ধ-দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষমুক্ত শান্তিময় এশিয়া গড়ার আকাঙ্ক্ষায় বুধবার ২৩ মে, ১৯৭৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল এশীয় শান্তি সম্মেলন। সম্মেলন চলেছিল তিন দিন। উদ্বোধন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলন আয়োজন করে এশীয় শান্তি পরিষদ। সে সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণ ছিল বঙ্গবন্ধুকে শান্তির জন্য ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদান। এ পদক নোবেল শান্তি পুরস্কারের পরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবচেয়ে মর্যাদাশীল ও সম্মানিত শান্তিপদক। নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে অতুলনীয় নেতৃত্ব প্রদানের জন্যে বঙ্গবন্ধুকে এশীয় শান্তি পরিষদ এ পদকে ভূষিত করে। সেদিনের সে সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বের মুক্তিকামী কণ্ঠস্বর মিলেছিল এক মোহনায়। সে সম্মেলনের প্রবেশমুখে ছিলো ব্রেজনেভ, হো চি মিন, বঙ্গবন্ধু, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিকৃতি। মঞ্চের দুপাশে ছিলো পদকের প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জুলিও কুরি ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। সে সম্মেলনে উত্তর ভিয়েতনাম, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস, দক্ষিণ আফ্রিকা, তৎকালীন সায়গন, প্যালেস্টাইন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, তৎকালীন জিডিআর, ভারত, হাঙ্গেরী, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বুলগেরিয়া, কানাডা, বৃটেন, মিশর, ইরাক, ফ্রান্স, জাপান, জর্দান, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, শ্রীলংকা, সিরিয়া, উত্তর ইয়েমেন, ওমান, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। বাণী দিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ। ‘জুলিও কুরি’ পদক সেদিন সম্মানিত হয়েছিল।

‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন বলেছিলেন, বিশ্বশান্তি আমার জীবন দর্শনের অন্যতম মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত এবং শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ-সে বিশ্বের যে কোনো স্থানেরই হোক না কেন, তাদের সাথে আমি রয়েছি।

উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, সকলের কাছে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে আমরা আস্থাশীল। আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব আমরা কামনা করি। সামরিক জোটগুলোর বাহিরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বলেছিলেন, শুধু সরকারের নীতিই নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতি সুদৃঢ় করা আমাদের সংবিধানের অন্যতম অনুশাসন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, আমরা মুক্তি সংগ্রামের আলোকেই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূল্য অনুধাবন করেছি প্রতি অণু-পরমাণুতে। আমরা জানি মুক্তিকামী মানুষের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করা যায় না। সেজন্যে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, বিসাউসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন।

বঙ্গবন্ধু অন্যায়ভাবে আরব এলাকা জোরপূর্বক দখলে রাখার জন্যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতিকে দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা জ্ঞাপন করেন সে সম্মেলনে ভাষণ দানকালে। সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি নিয়ন্ত্রীকরণ ও মানব কল্যাণের যে কোনো সৎ প্রচেষ্টার প্রতি জানিয়েছিলেন অকুণ্ঠ সমর্থন।

বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বৈরী মনোভাবের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, পাকিস্তান বার বার উপমহাদেশের নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে এসেছে। স্থায়ী শান্তি ও মানবিক কল্যাণে আমাদের উদ্যোগের সর্বশেষ প্রমাণ ১৭ই এপ্রিলের ভারত-বাংলাদেশ দৃপ্ত ঘোষণা। এই ঘোষণায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সূত্র খুঁজে বের করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্যে প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবে অনুকূল সাড়া দেয়ার পরিবর্তে পাকিস্তান প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে পাকিস্তানে বেআইনিভাবে আটক নিরাপরাধ বাঙালিদের বন্দীনিবাসে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এইভাবে পাকিস্তানের একগুঁয়ে নীতি উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁঁড়াচ্ছে। পাকিস্তানের অস্ত্র সরবরাহ প্রসঙ্গে কারো নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, কেউ কেউ আবার নতুন করে পাকিস্তানকে সজ্জিত করে চলেছেন নতুন নতুন সমরাস্ত্রে। নিঃসন্দেহে এটা স্থায়ী শান্তির যে কোনো শুভ উদ্যোগের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এশীয় শান্তি সম্মেলনে বলেছিলেন, আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক। তাকে সুসংহত করা হোক। বৃহৎ শান্তিবর্গ বিশেষভাবে আগ্রাসী নীতি অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা তথা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে আজ এক সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে অনুন্নত ও উন্নয়নকামী দেশসমূহের অর্থনৈতিক সাহায্য সংক্রান্ত মহা ঘোষণাগুলোও মূল্যহীন বলে প্রমাণিত হতে চলেছে। এই অস্ত্র প্রতিযোগিতার চক্রধারায় জড়িয়ে পড়ছে ছোট-বড়-মাঝারি অনেক দেশ। ফলে নানাভাবে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাজেট হচ্ছে স্ফীত। এ অবস্থার অবসান আমাদের একান্ত কাম্য। আমরা চাই অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্যে নিয়োগ করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলতে কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান উদ্বোধনী ভাষণের শুরুতে বলেছিলেন, শ্যামণ্ডসবুজ বাংলাদেশের সোনার মানুষ যুগ যুগ ধরে একান্তভাবে কামনা করেছে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি। কিন্তু পেয়েছে শুধু বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর হিংস্র ছোবল। যার পরিণতিতে আমাদের অর্থনীতি হয়েছিল বিপর্যস্ত। উপনিবেশবাদী শাসন আর শোষণের নগ্ন হামলাকে প্রতিরোধ করে ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা।

জাতির পিতা আরো বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাই শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে গেছে। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকচক্রের গণহত্যা, বর্বরতম জংলী নীতি ও সর্বোপরি চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকে প্রতিহত করে এক সাগর রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা লাভ করতে হয়েছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি, বিশ্বশান্তি তথা আঞ্চলিক শান্তির অপরিহার্যতা। বঙ্গবন্ধু বলেন, বিশ্বশান্তি পরিষদই একমাত্র সংস্থা যারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বিশ্বশান্তি পরিষদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে বিশ্বশান্তি পরিষদ আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। এ দেশের মানুষও ঠিক একইভাবে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সাথে সহমর্মিতা জানিয়ে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, আমি নিজে পিকিং (বেইজিং)-এ অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলীয় শান্তি সম্মেলনে একজন প্রতিনিধি ছিলাম। বিশ্বশান্তি পরিষদের ১৯৫৬ সালের স্টকহোম সম্মেলনে আমি যোগ দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমরা একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চাই। যুগ যুগ ধরে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং পাকিস্তানের ২৪ বছরের উপনিবেশবাদী লুণ্ঠন, সর্বোপরি নয় মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়েছে। আর বাংলার দুঃখী মানুষের ঘরে ভাত নেই, পরনের কাপড় নেই। এই ভুখা-নাঙ্গা মানুষকে বাঁচানোর জন্যে আমাদের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম বুভুক্ষা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম সফলকাম হওয়ার জন্য আমাদের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রয়োজন। এই জন্যেই উপমহাদেশসমূহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তির এলাকা ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছিলাম।

শান্তি পদক গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এ সম্মানের জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এ সম্মান কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের। মুক্তি সংগ্রামের বীর সেনানীদের। ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদক সমগ্র বাঙালি জাতির। আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের। এ সম্মেলনে যোগদানের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত প্রতিনিধি মিঃ ডীন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশের জনসাধারণ সংগ্রামের এক অনন্য দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা। তিনি বলেন, এতে বিশ্বেও মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হলো।

বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল শ্রী রমেশচন্দ্র বলেন, বঙ্গবন্ধু শান্তি ও স্বাধীনতার অগ্রদূত এবং বিশ্বেও মহান মানব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রেমীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।

এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে শান্তিকামী মানুষেরা মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা শান্তির অন্বেষায় রক্ত বিলাচ্ছেন আর বঙ্গবন্ধুর মত একজন মুক্তিকামী নেতাকে খুঁজে ফিরছেন। মুক্তির এ সংগ্রামে আমাদের হাতও মুষ্ঠিবদ্ধ হোক, কণ্ঠ গর্জে উঠুক-বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই হোক প্রত্যাশা।

লেখক : উপ-প্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ, পিআইডি, ময়মনসিংহ, [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়