প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৩, ০০:০০
![বাঁশের তৈরি পণ্য বিক্রি করেই চলে শতবর্ষী বৃদ্ধ যদুলাল বাইনের সংসার](/assets/news_photos/2023/05/04/image-32525.jpg)
বাঁশ আর বেতকেই জীবিকার প্রধান বাহন হিসেবে ধরে রেখেছেন মতলব উত্তর উপজেলাধীন ১৬নং সুলতানাবাদ ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি পরিবার। কিন্তু দিন দিন বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় অভাব অনটনে দিন পার করছেন বাঁশমালীরা।
জানা যায়, বংশ পরম্পরায় পূর্ব পুরুষদের এ পেশায় গত কয়েক বছরে আগে বেশ সফলতা ছিল। কিন্তু প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রী বাজারে আসার কারণে কমে গেছে বাঁশের তৈরি পণ্যের চাহিদা। অন্যদিকে প্লাস্টিক পণ্যের দাম বাঁশের তৈরি পণ্যের চেয়ে অনেক কম। আগে ৫০০ টাকার বাঁশ কিনে সেই বাঁশ দিয়ে পণ্য তৈরি করে ১ হাজার ৫শ’ টাকা বিক্রি করা যেত। কিন্তু বাঁশের দাম বাড়ার কারণে এখন ৫০০ টাকার বাঁশ কিনে সেই বাঁশ দিয়ে পণ্য তৈরির পর ১০০০ টাকায়ও বিক্রি করা যায় না।
বাঁশমালীরা জানান, ৫০টি পরিবার বাঁশের তৈরি চাটাই, খাঁচা, বিটে, পলো, আন্টা, কুলা, পাখা, ডালি, ভাড়, ঝাড়ু, হাঁস-মুরগি রাখার খাঁচাসহ নানা পণ্য তৈরি করে হাট-বাজারে বিক্রি করে কোনো মতো চালাচ্ছেন তাদের সংসার। বাঁশের তৈরি পণ্য ছাড়া অন্য কোনো কাজ তাদের জানা নেই। তাই পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এটাই করেন। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিলে পরিবারগুলো আরো ভালো পণ্য তৈরি করে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে জানান বাঁশমালীরা।
ওই গ্রামের দ্বিজলাল বিশ্বাস বলেন, এসব জিনিসপত্র তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশ। বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশ সংগ্রহ করার পর তা দা-ছুরি দিয়ে চিরানো হয়। পরে বাঁশগুলো দিয়ে পণ্যের মানভেদে চিকন আকারের শলা বা বাতি তৈরি করে রোদে শুকাতে হয়। এরপর বানানো হয়ে থাকে নানা সামগ্রী। এ কাজটি তার বাপ-দাদার আমল থেকে করে আসছেন। তবে পুঁজি থাকলে এই পেশায় স্বাবলম্বী হওয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি পেশার মানুষকে এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি। বাঁশমালীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
শতবর্ষী বৃদ্ধ যদুলাল বাইনের তিন ছেলে মনিন্দ্র চন্দ্র সরকার, বাবুল চন্দ্র সরকার ও প্রিয়লাল চন্দ্র সরকার এবং একমাত্র মেয়ে মণি রাণী সরকার। এর মধ্যে গেলো বছর ২৫ ডিসেম্বর জন্ডিস ও লিভার কান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তাঁর ছোট ছেলে সুজাতপুর বাজারের টেইলার্স প্রিয়লাল সরকার (৪৫) এবং গেলো ৪/৫ বছর আগে তাঁর সহধর্মিণীও না ফেরার দেশে চলে গেছেন। প্রিয়তমা স্ত্রী আর আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে শতবর্ষী যদুলাল বাইন আজ অসহায়। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ বয়সেও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন মতলব উত্তর উপজেলাধীন সুলতানাবাদ ইউনিয়নস্থিত কোয়রকান্দি গ্রামের ১শ’ ১৫ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ যদুলাল বাইন। তার নাতি অমল চন্দ্র সরকার বলেন, অতীতে গ্রামে গঞ্জে বাঁশের তৈরি সামগ্রীর কদর ছিলো অনেক। এসব পণ্য শোভা পেতো প্রত্যেক বাড়িতে। গৃহস্থালির নিত্য ব্যবহারের দ্রব্যাদি, ডালা, চালুন, ডুলি, খরপা, চাটাইসহ অসংখ্য জিনিস আজও তৈরি করে ক্রেতাদের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। তবে ইদানীং নানা প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন তা হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে এ ব্যবসায় মন্দাভাব থাকায় বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোর চলছে দুর্দিন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে বাঁশের পণ্য তৈরি ও তা বিক্রি করে কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করেছেন গ্রামের প্রায় অর্ধশত পরিবার। তিনি আরো বলেন, সরকারি ও বে-সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা পেলে বাঁশ শিল্পের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
স্থানীয় মেম্বার আবদুল হক মৃধা বলেন, বাঁশের তৈরি পণ্য বাঙালির পুরোনো ঐতিহ্য। পুরোনো এই ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু পূর্ব পুরুষের এই পেশাকে এখনো ধরে রেখেছেন কোয়রকান্দি গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার। বাঁশের সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাঁশমালীরা। তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় নানা রকমের বাঁশের তৈরি পণ্য। পূর্ব পুরুষদের এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে তারা এখনো তৈরি করছেন ঝুড়ি, ডালা, কুলা, চালুনি, খলুই, হাতপাখাসহ নানা পণ্য।
মতলব উত্তর উপজেলাধীন সুলতানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক খোকন বলেন, এটি একটি লাভজনক পেশা। বাঁশ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।