প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করে এবং জনবিচ্ছিন্নদের দলের মনোনয়ন দেয়া হলে তার রেজাল্ট কী আসে তা হাড়ে হাড়ে বুঝ পেয়েছে ফরিদগঞ্জ আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতামতকে উপেক্ষা করার জবাব ভোটাররা দিয়ে দিয়েছেন ব্যালটের মাধ্যমে। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৩ ইউপি নির্বাচনে এ জবাব ফুটে উঠেছে। ১৩টির মধ্যে মাত্র তিনটিতে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। বাকি দশটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছে। আর এই দশটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের চরম ভরাডুবি হয়েছে। দশটি ইউনিয়নেই নৌকার প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে হেরেছে। খোদ এমপির নিজ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী তৃতীয় হয়েছে। এই ইউনিয়নে জয়লাভ করেছে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী। যে বর্তমান চেয়ারম্যান। বিজয়ী প্রার্থী এবং বিজিত নৌকার প্রার্থীর সাথে ভোটের ব্যবধান হবে প্রায় ডাবল। স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান যে দল থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন তা তার নিজ ইউনিয়নসহ ফরিদগঞ্জের দশ ইউনিয়নের ভোটের চিত্র বলে দিচ্ছে। এমনটাই মন্তব্য এখন ফরিদগঞ্জবাসীর।
গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। এই ১৩ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন পেতে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান যে তালিকা দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের কাছে দিয়েছেন, তারা সবাই দলের মনোনয়ন তথা নৌকার টিকিট পেয়েছেন। আর তার পছন্দের প্রার্থীদেরই নির্বাচনে ভরাডুবি হলো।
জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্ধিত সভার মাধ্যমে তৃণমূলের মতামত নিয়ে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করে ফরিদগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ। এই তালিকা জেলা আওয়ামী লীগের কাছে পাঠানো হয়। এদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান উপজেলা আওয়ামী লীগের তালিকা প্রত্যাখ্যান করে তিনি ভিন্ন একটি তালিকা জেলা আওয়ামী লীগের কাছে পাঠান। জেলা আওয়ামী লীগ উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে পাঠানো তালিকা ঠিক রেখে শফিকুর রহমান এমপির তালিকা একসাথ করে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের কাছে পাঠিয়ে দেয়। দেখা গেছে যে, এমপি শফিকুর রহমানের প্রেরিত তালিকার সবাই দলের তথা নৌকার মনোনয়ন পেলেন। তৃণমূলের মতামত নিয়ে প্রস্তুতকৃত তালিকাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এ নিয়ে ফরিদগঞ্জ আওয়ামী পরিবারে তীব্র ক্ষোভ অসন্তোষ ছিল। ১৩ ইউনিয়নে যারা দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের অনেককেই দলের নেতা-কর্মীরা চিনেও না। দলীয় কোনো কর্মকা- বা বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামের কোথাও তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এরা শুধু শফিকুর রহমান এমপির পকেটের বা পছন্দের লোক এটাই তাদের পরিচয়। এমন মন্তব্য ফরিদগঞ্জ উপজেলার বৃহত্তর আওয়ামী পরিবারে। মূলত এই ১৩ জন হচ্ছেন এমপির একমাত্র ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন খাজা আহমেদ মজুমদারের মনোনীত এবং পছন্দের ব্যক্তি। তার পছন্দ এবং মতামতকেই মূলত প্রাধান্য দিয়েছেন এমপি শফিকুর রহমান। খাজা আহমেদ মজুমদারের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই এমপি শফিক তৃণমূলের মতামতকে শতভাগ উপেক্ষা করেছেন। তিনি তাঁর পছন্দের লোকদের তালিকা প্রস্তুত করতে গিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে সামান্যতম যোগাযোগও করেন নি। অর্থাৎ খাজা আহমেদ মজুমদার যার নাম দিয়েছেন, এমপি শফিকুর রহমান তার নামই তালিকায় রেখেছেন। এ সুযোগে খাজা আহমেদ মজুমদার প্রতিজন থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে ফরিদগঞ্জজুড়ে জনশ্রুতি রয়েছে। আর এর মাশুল দিতে হলো দলকে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ফরিদগঞ্জে নৌকার শোচনীয় পরাজয় ঘটলো।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৩টি ইউপি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, রূপসা দক্ষিণ, চরদুঃখিয়া পূর্ব ও গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে শুধু আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী জয়লাভ করে। বাকী ১০টি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং বিএনপির প্রার্থীরা (স্বতন্ত্র পরিচয়ে) জয়লাভ করে। এ ১০টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে হেরেছে। ১০ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের অবস্থান হচ্ছে- দুটিতে চতুর্থ, পাঁচটিতে তৃতীয় এবং তিনটিতে দ্বিতীয়। এই ১০টিতেই বিজয়ী প্রার্থীর সাথে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান বিশাল। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমানের নিজ ইউনিয়ন ২নং বালিথুবা পূর্ব ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এমপির চাচাতো ভাই জিএম হাসান তাবাচ্চুম হয়েছেন তৃতীয়। এ ইউনিয়নে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ। আনারস মার্কা নিয়ে তিনি পেয়েছেন ৪৯৫৫ ভোট। আর নৌকা প্রতীক নিয়ে জিএম হাসান তাবাচ্চুম পেয়েছেন ২৬৪০ ভোট।
অন্যান্য ইউনিয়নে নৌকার অবস্থান হচ্ছে-চরদুঃখিয়া পশ্চিম ইউনিয়নে নৌকা চতুর্থ। এই ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছে আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি পেয়েছেন ৫০৬০ ভোট। আর নৌকার প্রার্থী মোরশেদ আলম মুরাদ পেয়েছেন ১৪৪৩ ভোট।
সুবিদপুর পূর্ব ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মোঃ শারাফত উল্লাহ চতুর্থ হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ২৪৭৩ ভোট। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ বেলায়েত হোসেন (চশমা) পেয়েছেন ৩৪০০ ভোট।
সুবিদপুর পশ্চিম ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী পারভেজ হোসাইন তৃতীয় হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ২২৮৩ ভোট। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ মহসিন হোসেন (আনারস) পেয়েছেন ৪৯৭২ ভোট।
গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী আব্দুল গনি পাটওয়ারী তৃতীয় হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ২১৯৭ ভোট। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ শাহজাহান পাটওয়ারী (চশমা) পেয়েছেন ৩৫২৫ ভোট।
পাইকপাড়া উত্তর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন তৃতীয় হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ২২৯৪ ভোট। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু তাহের পাটওয়ারী (মোটরসাইকেল) পেয়েছেন ৩৯৪৯ ভোট।
গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী রফিকুল ইসলাম তৃতীয় হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ৩০৬৬ ভোট। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী বুলবুল আহমেদ (আনারস) পেয়েছেন ৩২৭৫ ভোট।
বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মোঃ বাহাউদ্দিন দ্বিতীয় হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ৩৫৬৯ ভোট। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী জসিম উদ্দিন স্বপন মিয়া (আনারস) পেয়েছেন ৮১১৮ ভোট।
গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী সোহেল চৌধুরী দ্বিতীয় হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ৩১৩৮ ভোট। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ শাহআলম (চশমা) পেয়েছেন ৪৩৭৯ ভোট।
রূপসা উত্তর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মোঃ ওমর ফারুক দ্বিতীয় হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ৩৭৪২ ভোট। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম কাউসারুল আলম (মোটরসাইকেল) পেয়েছেন ৪০৪১ ভোট।