প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
প্রারব্ধ কর্ম
বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য আছে ‘যার না হয় নয় বছরে, তার না হয় নব্বই বছরে।’ আজও এ প্রবাদ বাক্যটি ঠাকুর-মার ঝুলিতে ঝুলছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এক অনন্য পংক্তিতে শোভা পাচ্ছে ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ বাংলার জল, বাংলার ফল বাংলার মলয় শীতল বায়ু, আর বাংলার ফুলের সুবাসের আবেশে ঘুমন্ত পিতা জাগরিত হয়ে যায় এবং সন্তানকে প্রণিধানযোগ্য পথে পরিচালিত করে।
মানব জীবনচক্রটা হলো ভ্রুণ-মাতৃজঠর-নবজাতক-শৈশব-বাল্যকাল-তারুণ্য-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য-অতিবার্ধক্য। তন্মধ্যে শৈশব, তারুণ্য এবং কৈশোর অবধি চিন্তা শক্তিতে কিছুটা কোমলমতিত্ব বিরাজমান থাকবেই। এর প্রভাব বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ)তে প্রভাবান্বিত হবে। তারপর কৈশোরের মাঝামাঝি থেকে পুরোটা যৌবন পর্যন্ত বুদ্ধির মাতামাতিতে জীবন প্রবহমান থাকবে। যেমন ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার ভিকারুন্নেছা নুন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রমে পার্শ্ববর্তী রাস্তাটি মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করে।
এই বাংলার জল-স্থল-অন্তরীক্ষ পরিব্যাপ্ত আছে এক অভ্রান্ত অলৌকিক শক্তিতে। ফলস্বরূপ বুদ্ধিদীপ্ততার পরিপক্ষ তারুণ্য, যা কৈশোর বয়সেই চলে আসে। আর সে জন্যেই বাংলার মানব সন্তানের বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ) যথেষ্ট ক্ষিপ্রতার সাথে এই বাংলার স্তরে স্তরে পরিব্যাপ্ত হয়। তাই মহামতি বিজ্ঞানী নিউটন জীব জগতের জন্যে একটা চির সত্য বাণী রেখে গেলেন যে, ‘প্রত্যেকে ক্রিয়ারই একটা সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।’
বাংলাদেশের পতিত শাসক গোষ্ঠী কতিপয় ভাল কাজের পাশাপাশি এমন অনেক রাষ্ট্রদ্রোহী অপকর্ম করেছে, যার ফলে তারা হাড়ে হাড়ে নিন্দিত এবং কুৎসিত স্বৈরাচারী আচরণে মজ্জাগত। ফলস্বরূপ হয়েছে নির্বাসিত।
‘বিশ্ব কবির সোনার বাংলা’, ‘নজরুলের বাংলাদেশ’, জীবনানন্দের ‘আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি রূপসী বাংলার রূপ।’ সেই বাংলার দামাল ছেলেমেয়েরা ছাত্র-জনতার সহায়তায় এক গণঅভ্যুত্থান ঘটায়। ফলে অধিষ্ঠিত স্বৈর শাসক দেশ থেকে পলায়নে বাধ্য হয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত গণঅভ্যুত্থানের চাইতে প্রকটতর গণঅভ্যুত্থান ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকার বুকে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে প্রথমোক্তটি বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির লক্ষ্যে আর দ্বিতীয়টি স্বৈরাচার প্রধান শেখ হাসিনার পদচ্যুতির জন্যে। যে সফলতাকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী আম জনতা অভিহিত করেছে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবে। অসম্ভবকে সম্ভব করেছে উদ্দাম তারুণ্য এবং অনুপ্রাণিত করেছে বিশ্ববরেণ্য নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. ইউনুছের বদান্যতা, যিনি অত্যন্ত সদ্বক্তা। এটা কিন্তু নিশ্চিত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
এ বিশ্বে এ যাবৎ কালে যতগুলো অটোক্রেটার এসেছে তারা সাধারণত তিনটা প্রধান কাজ করেছে--
এক. অযোগ্য এবং আজ্ঞাবহ লোককে বিশেষ স্থানে বসানো।
দুই. সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য প্রশাসনিক শক্তিকে সর্বদা তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট থাকা।
তিন. জনগণের সম্মুখে এমন কিছু জনহিতকর কাজ করে, যা অবশ্যই দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু এগুলো যে অর্জিত পাপকে খণ্ডাতে পারে না তা অুনধাবন করার প্রজ্ঞা প্রাকৃতিক নিয়মেই বিলুপ্ত হয়।
সুলতান সুলাইমান কানুনী ছিলেন উসমানিয়া সাম্রাজ্যের দশম ও সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী শাসনরত প্রভাবশালী সুলতান। যিনি ১৫২০ খ্রিঃ থেকে ১৫৬৬ খ্রিঃ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশ্বনন্দিত প্রজাবৎসল এবং ন্যায়পরায়ণ একজন সুশাসক ছিলেন। হয়তো শেখ হাসিনার উচ্চাভিলাষ তাঁকে ধরাতে দ্বিতীয় সুলেমান হতে দিবাস্বপ্নে বিভোর করে রেখেছিল। দিবা স্বপ্ন অলীক তো, অলীকই থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি হয়েছে রোমানিয়ার স্বৈরশাসকের মতোই। রোমানিয়ার স্বৈরশাসক নিকোলাই চশেস্কু, যিনি ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন, অবশেষে ১৯৮৯ সালের রোমানীয় বিপ্লবে চশেস্কুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বিমানে শেখ হাসিনা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন, কিন্তু নিকোলাই চশেস্কুর জন্যে নির্ধারিত ছিল মৃত্যুকূপ।
এই পাক ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার বীর সূর্যসেন মাস্টার দা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, লোকনাথ বলসহ আরো অনেক বঙ্গীয় বীর পুরুষ আর দখলদার দুর্ধর্ষ পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এই উদ্যম জুগিয়েছিল বিদ্রোহী কবির উত্তপ্ত উচ্চারণ ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল, মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।’ আর সাহস জুগিয়েছে সাতই মার্চের যুগান্তকারী ভাষণ।
সর্বংসহা এ ধরিত্রীর অনুপম ভূখণ্ড বাংলাদেশটি বিগত কয়েক যুগ অবধি রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত। যা উন্নয়নের নির্ঘাত অরি সংকুল। বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশই হলো তরুণ। যাদের বয়স ১৫ বছর থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। এদেরকে রাষ্ট্রীয় জনহিতকর কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিবর্তে সৃষ্টি করা হয়েছিল ‘আয়না ঘর’ অথবা ‘হাওয়া ভবন।’ উভয়টি সুশাসন বিরোধী এবং একনায়কতান্ত্রিকতার অপকৌশল মাত্র। পরিশেষে দেশবাসীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, যেন এগিয়ে আসা ছাত্র সমাজ নিরুৎসাহিত না হয়ে প্রকৃত সমাজসেবক হয়ে ভবিষ্যতের অনুকরণীয় হতে পারে সেই প্রেরণার উৎস সৃষ্টি করা। দীর্ঘদিনের বাংলাদেশের তথা কথিত সমাজসেবকরা যেন তাদের খোলস পরিবর্তন করে ফেলে। দেশ যদি একবার প্রকৃত উন্নয়নের রেলে উঠে যায়, তবে সকলেরই প্রাপ্তব্য হাড়ে-হাড়ে নিবৃত্ত হবেই। এখানে শ্রেয়তম হওয়া উচিত শুধুই মানবতা-বাদিত্ব, আর ধর্ম-বর্ণ-গোত্র শুধুই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।