প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
এখন ডিমেনশিয়া-আলঝাইমার্স নিয়ে কাজ করার সময়
মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে স্মৃতি বিকৃতি ঘটলে সেটাকে ডিমেনশিয়া বলে। ডিমেনশিয়া স্মরণ শক্তি, চিন্তা শক্তি, আচার আচরণ, বিচার বিবেচনা, চলাফেরা,খাওয়া-দাওয়া, স্থানকাল, অনুভূতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বেশ কিছু রোগের কারণে মস্তিষ্কের পরিবর্তন ঘটে যা শেষ পর্যন্ত স্নায়ু কোষের ক্ষতি করে ডিমেনশিয়ার সৃষ্টি হয়। আমরা সাধারণত চার ধরনের ডিমেনশিয়া সম্পর্কে জানি। চারটি ধরণ হলো-- আলঝাইমার্স রোগ, ভাসকুলার ডিমেনশিয়া, লিউবডি ডিমেনশিয়া, ফ্রন্টো টেম্পোরাল ডিমেনশিয়া।
ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আলঝাইমার্স। এটা মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষ ও স্নায়ুতন্ত্রের ধ্বংস করে স্মৃতি শক্তির বিকৃতি ঘটায়।
আলঝাইমার্স রোগের শুরুর দিকে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা প্রায়ই বলতে থাকেন যে, এটা বার্ধক্যজনিত সমস্যা তেমন কিছু না! এই বয়সে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। যে কোনো বয়সে আলঝাইমার্স রোগ হতে পারে, তবে পঁয়ষট্টি বছরের অধিক বয়সী লোকদের বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। আবার পুরুষের তুলনায় নারীর মধ্যে এই রোগ হবার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।
এ রোগটি শুরু হয় অত্যন্ত ধীর গতিতে। ফলে কোন্ সময় থেকে আরম্ভ হলো তা শনাক্ত করা খুবই কঠিন। পরিবারের সদস্যরা প্রথমেই এই রোগ সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্ক আমরা যা ভাবি, অনুভব করি, মনে করি তার সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করে। এমন কিছু রোগ রয়েছে যা একজন ব্যক্তির মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে কাজ করতে বাধা দেয়। যখন একজন ব্যক্তির এই রোগগুলোর একটি থাকে তখন তার চিন্তা-ভাবনা করতে, মনে রাখতে, কথা বলতে, কথা বুঝতে সমস্যা তৈরি করে।
ডিমেনশিয়া রোগ নির্ণয় করতে স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞ, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, হরমোন বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড লাগতে পারে। স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল, হরমোনের সমস্যা এবং বিষণ্নতা যাঁদের আছে তাঁদের ডিমেনশিয়া হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে হার্টের যত্ন নিন, ফলমূল, শাক সবজি, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধূমপান বন্ধ করতে হবে, মস্তিষ্কের ব্যবহার বাড়িয়ে তুলুন এবং নতুন কাজ নিয়ে ভাবুন, ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখুন, হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ রাখবেন এবং সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ বাড়িয়ে দিন। নিজেকে সক্রিয় রাখুন, শুয়ে বসে অলস সময় কাটাবেন না। সপ্তাহে ১৪ ইউনিটের বেশি অ্যালকোহল গ্রহণ করা যাবে না।
আলঝাইমার্স রোগের প্রাথমিক স্তরে রোগী গুছিয়ে কথা বলতে না পারা, সাম্প্রতিক ঘটনা মনে করতে না পারা, সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করা, পরিচিত জায়গা চিনতে না পারা, সময় জ্ঞান না থাকা, নামাজ পড়েছেন কিনা মনে করতে পারেন না, ওষুধ খেয়েছেন কিনা তা মনে করতে পারেন না, বিষণ্নতায় ভোগা, আচরণের পরিবর্তন হওয়া, শখের জিনিসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করতে না চাওয়া।
মধ্যবর্তী স্তরে রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সমস্যা আরো প্রকট হয়ে যায়। সমস্যা রোগীর নিত্য সঙ্গী হয়ে পড়ে। রান্না বান্না, কাপড় কাচা, ক্রয়, বিক্রয়, হিসাব, নিকাশ কঠিন হয়ে যায়। রোগী কথা বলতে কিংবা যোগাযোগ করতে পারে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে চলাফেরা করে, অতি পরিচিত ব্যক্তির নাম- চেহারা ভুলে যায়, পথ-ঘাট ভুলে যায়, কোন কিছু খুঁজে পায় না, জিনিসপত্র চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ করা ইত্যাদি।
শেষ স্তরে এসে রোগী খাবার চিবোতে পারে না অথবা খাবার কীভাবে গিলতে হয় তা ভুলে যায়, যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করে, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবকে চিনতে পারে না, হাঁটতে অসুবিধা হয়, হুইল চেয়ার কিংবা বিছানায় আটকে পড়ে, নিজ বাড়িতে পথঘাট, টয়লেট, শোবার ঘর চিনতে পারে না। শারীরিক সমস্যাগুলোর কথা বলতে পারে না।
আলঝাইমার্স রোগের চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি, তবে রোগীর অস্থিরতা, বিষণ্নতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, হরমোনের সমস্যা ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখতে চিকিৎসকরা ওষুধ দিয়ে থাকেন। আলঝাইমার্স রোগীর সাথে বসবাস এবং তাদের পরিচর্যা কেমন হবে সে বিষয়ে আমাদের ধারণা অনেক কম। যাঁরা আলঝাইমার্স রোগীর সেবায় থাকবেন তাদের কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।
(১) সাধারণ কাজকর্ম ব্যাহত না করে একটা রুটিন প্রণয়ন।
(২) স্বাধীনভাবে জীবনযাপনে সহায়তা করুন।
(৩) আত্ম মর্যাদা রক্ষায় সহায়তা করুন।
(৪) হাসি খুশি থাকুন এবং রাখুন।
(৫) দৈনন্দিন কাজ গুলো সহজতর করা।
(৬) দৈহিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিন।
(৭) শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতাকে দীর্ঘ করার চেষ্টা।
(৮) বর্তমান কার্য ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া।
(৯) ব্যক্তিগত যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন।
(১০) গান শুনতে দিন, স্মৃতিচারণ করুন।
(১১) পোষা প্রাণীর সাথে খেলতে দিন।
(১২) সম্ভব হলে শিশুদের সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করার সুযোগ করে দিন।
সেবাকর্মীকে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে :
(১) রোগীর মতামত নিয়ে তার পছন্দ মতো গোসল করাতে হবে। সম্ভব না হলে ভিজে কাপড়ে গা মুছে দিতে হবে।
(২) ঝামেলা মুক্ত সহজ পোশাক পরিচ্ছদ তার সামনে রাখতে হবে। তিনি যেটা পছন্দ করেন সেটা পরিধানে সহায়তা করতে হবে।
(৩) অপিচ্ছিল রাবার সোলের জুতা পরতে দিন।
(৪) শৌচকর্ম ও মলমূত্রের বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দিনের নির্দিষ্ট একটা সময়ে পায়খানা করানোর চেষ্টা করতে হবে। না করাতে পারলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
(৫) রোগীর রান্না-বান্নার সখ থাকলে সহযোগিতা করুন। রান্নার কাজটি আনন্দদায়ক করার চেষ্টা করলে ভালো হবে। ধারালো ছুরি কাঁচি দূরে সরিয়ে রাখুন।
(৬) খাদ্যগ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগী কতবার খেয়েছেন, আদৌ খেয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। খাবার ঠাণ্ডা না গরম তা নিজের মুখে দিয়ে বুঝতে হবে। খেতে অসুবিধা হলে তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে কীভাবে খাবার চিবিয়ে খায়। খাবার ছোট ছোট অংশ করে রোগীর মুখে দিতে হবে।
(৭) যানবাহনে চলাচলে সতর্ক হতে হবে। রোগী নিজে চালক হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গাড়ি চালাতে দেয়া ঠিক না।
(৮) ময়লা আবর্জনার ঝুড়ি পরিষ্কার করার সময় নিজে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু ময়লার ঝুড়ির মধ্যে চলে যায় কিনা। অনেক সময় রোগী নিজেই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয়।
(৯) রোগী যখন একই কথা বারবার বলে এবং একই কাজ বারবার করে তখন তাকে কৌশলে মনোযোগ অন্য দিকে সরাতে হবে।
(১০) রোগীর ধূমপানের অভ্যাস থাকলে বন্ধ করতে হবে, কারণ যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।
(১১) মদপানের অভ্যাস থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে সীমিত পরিমাণে অ্যালকোহল পান করা যাবে।
সেবাকর্মীর শারীরিক ও মানসিক চাপ মোকাবিলা করার দক্ষতা খুবই জরুরি বিষয়। তাদের দুঃখ বোধ, অপরাধ বোধ, রাগ ক্রোধ, হতবুদ্ধি ও অপ্রস্তুত হওয়া, নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত থাকতে কাউন্সেলিং করাতে হবে। শরীর ঠিক রাখতে সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়াম জরুরি। প্রতি মাসে নিজের জন্যে কয়েকটি দিন রাখতে হবে। কয়েকটি দিন পরিবার পরিজন এবং নিজের জন্যে সময় দিন। নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হোন। কোনো কিছুর জন্যে নিজেকে মোটেই দায়ী মনে করবেন না। উপদেশ নিন এবং উপদেশ চান। মনে রাখবেন আপনার গুরুত্ব কারো চাওয়া না চাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। ডিমেনশিয়ার চিকিৎসায় সমবেদনা, যত্ন, সাহস, প্রতিশ্রুতি, যোগ্যতা এবং যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সেবাকর্মীর জন্য পরামর্শ হলো : শান্ত থাকুন, অনুভূতির প্রতি সাড়া দিন, ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করুন, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নিজেকে সরিয়ে নিন এবং পরে ফিরে আসুন।
পরিবারের সদস্য এবং সেবাকর্মীর মনে রাখতে হবে, রোগীর যৌন আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন কাউকে জড়িয়ে ধরা, স্পর্শ কাতর স্থানে হাত দেয়া, যৌনাঙ্গে স্পর্শ করা, নিজে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বা চলাফেরা করা। সঙ্গীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে সময় জ্ঞান এবং পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা না করা। আলঝাইমার্স রোগী অনেক সময় যৌনকর্মে সক্ষম থাকেন।
ডিমেনশিয়া ও আলঝাইমার্স রোগ বিষয়ে আপনার ভূমিকা যা হতে পারে তা হলো :
১. পদযাত্রা, মানববন্ধন, সেমিনার, তহবিল সংগ্রহ।
২. রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে রোগের লক্ষণ, চ্যালেঞ্জ, করণীয় বিষয়ে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজনকে সভা সমাবেশে হাজির করানো কিংবা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সভা- সমাবেশ করা। ৩. কোথায় কেয়ার গিভার পাওয়া যাবে এবং কেমন খরচ হবে তার একটা যৌক্তিক পরিকল্পনা করা। ৪. স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করতে অন্যদের সহযোগিতা ও সমর্থন পাবার চেষ্টা করুন।
৫. গবেষণার জন্যে তহবিল সংগ্রহ করা জরুরি। গবেষণার মাধ্যমে প্রবীণ জীবনযাপনের নানান দিকগুলো জানা যাবে।
৬. আপনার অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, মতামত, উপলব্ধি শেয়ার করতে পারেন।
লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।