রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

দুই কোটি প্রবীণের জন্য বাজেটে কী আছে?

হাসান আলী
দুই কোটি প্রবীণের জন্য বাজেটে কী আছে?

বাজেট হলো সরকারের এক বছরের আয় ব্যয়ের দলিল যা সংসদে পাস করে। এতে কোন কোন খাত থেকে কর আদায় করা হবে এবং কোন কোন খাতে তা ব্যয় করা হবে তার বিস্তারিত বিবরণ থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি প্রবীণের বসবাস। মোট জনসংখ্যার ১১.৬৬ শতাংশ মানুষ প্রবীণ। এবারের বাজেটে প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ০.৫৫ শতাংশ। বয়স্ক ভাতার আওতায় আসবে ৬০ লক্ষ ১ হাজার প্রবীণ।

অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ অনুদানের অর্থ ইএফটির মাধ্যমে প্রদানের উদ্যোগে নেয়া হবে এতে ভোগান্তি কমে যাবে। সরকার পেনশনারদের পেনশন প্রাপ্তি সহজ করেছে। অবসরভোগীরা ইএফটির মাধ্যমে মাসের শুরুতেই পেনশন পাচ্ছেন। জীবিত অবস্থা যাচাইকরণ পাইলট ভিত্তিতে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে লাইফ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা থাকবে। ফলে পেনশনাররা বছরে একবার সশরীরে হাজির হয়ে জীবিত অবস্থা প্রমাণ করার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে। ঘরে বসে পেনশন পাবে।

সর্বজনীন পেনশন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আইন ২০২৩ সংসদে পাস হবার পর অর্থ বিভাগ সর্বজনীন পেনশন স্কীম বিধিমালা ২০২৩ জারি করে। এটি প্রবীণদের আর্থিক মুক্তির সনদ বিবেচিত হবে। সর্বজনীন পেনশন স্কীম ৪টি যথা প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের এ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে। ১ জুলাই ২০২৫ থেকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি-কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন স্কীমের আওতায় থাকবে। বাজেটে প্রবীণদের কল্যাণে যে সকল বিষয় যুক্ত করা যায় সেসব প্রস্তাবনা আকারে তুলে ধরছি।

স্বাস্থ্য প্রবীণ জীবনের সবচেয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করার পর অধিকাংশ প্রবীণ কয়েকটি অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার, কিডনি, হাঁপানি, ক্যান্সার, বাত ব্যাথা, থাইরয়েডসহ কয়েকটি চিকিৎসা ও ওষুধ সেবন করতে হয়। সরকার বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করছে। শিশুদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সেবা দিতে শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছে। প্রবীণরা শিশুদের মতো অনেকটা নির্ভরশীল।

প্রবীণদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রবীণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করার প্রস্তাব করছি। প্রবীণদের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিনিয়ত ওষুধ সেবন করতে হয়। অসহায় দরিদ্র-প্রবীণদের পক্ষে উচ্চমূল্যের ওষুধ ক্রয় করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। পাইলট ভিত্তিতে ৫০ হাজার দরিদ্র প্রবীণকে বিনামূল্যে বা সাশ্রয়ী মূল্যে সারা বছর ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্ত চাপ, হাঁপানির ওষুধ দেয়া যেতে পারে।

সরকারি হাসপাতালে প্রবীণ চিকিৎসায় অগ্রাধিকার থাকতে হবে। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট সংগ্রহ, বিলের টাকা জমা দেয়া, ভর্তির জন্য অপেক্ষা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা প্রবীণদের জন্য খুবই কষ্টের বিষয়। নানান কারণে আমাদের প্রবীণরা চিকিৎসা গ্রহণের সময় নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে সাথে নিয়ে আসতে পারেন না। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সিরিয়াল পেতে ভোগান্তিতে পড়েন। প্রত্যেক হাসপাতালে অন্তত একজন প্রবীণ সহকারী রাখার প্রস্তাব করছি। যাতে তিনি প্রবীণের ভোগান্তি লাঘবে সহায়তা করতে পারেন। দেশের অধিকাংশ প্রবীণের বসবাস গ্রামে। অসুস্থ প্রবীণ শুরতেই চিকিৎসা পেলে কম জটিলতায় পড়বে। সারা দেশে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এগুলোতে প্রবীণদের জন্য কমিউনিটি কেয়ার সার্ভিস হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করছি। প্রত্যেক গ্রামে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রবীণ সেবা কর্মী থাকলে নির্ধারিত সেবামূল্য পরিশোধ করে সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবে।

প্রবীণদের শারীরিক অসুস্থতায় অনেক সময় পায়খানা-প্রস্রাবের বেগ সামলাতে না পেরে কাপড় চোপড়, বিছানাপত্র নষ্ট করে ফেলেন। প্রবীণ নিজে এবং পরিবারের সদস্যরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। সুলভমূল্যে ডায়াপার ক্রয়ের সুযোগ তৈরি হলে প্রবীণরা পরিবার-পরিজনের সাথে শান্তিতে স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। শুল্কহার কমিয়ে ডায়াপার ক্রয় সীমার মধ্যে রাখার প্রস্তাব করছি।

শিশু ও নারীদের বিভিন্ন মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি থেকে সুরক্ষার জন্য সরকার সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) অব্যাহত রেখেছে।

বর্তমানে ইপিআই কর্মসূচির আওতায় ১১টি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে টিকাদান কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। প্রবীণদের সংক্রামক ব্যাধির থেকে রক্ষা করতে নিউমোনিয়া, হেপাটাইটিস, ফ্লু, টাইফয়েড, কলেরার টিকা ইপিআই কর্মসূচির আওতায় আনার প্রস্তাব করছি। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রবীণ দিবা যত্নকেন্দ্র পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে এর কার্যকারিতা যাচাই করার প্রস্তাব করছি।

প্রবীণের স্বাস্থ্য অবনতির দিকে যেতে থাকলে একটা সময় মেডিকেল বেডের প্রয়োজন হয়। উচ্চমূল্যের মেডিকেল বেড সবার পক্ষে নেয়া সম্ভব হবে না। স্বল্প ভাড়ায় উপজেলা হেল্থ কমপ্লেক্স থেকে সুলভমূল্যে মেডিকেল বেড নেবার সুযোগ বাজেটে রাখার রাখার প্রস্তাব করছি।

বাজেটে ক্রীড়া উন্নয়নে প্রবীণদের জন্য কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। ধরে নেয়া হচ্ছে প্রবীণরা খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ করতে সক্ষম নন। এটা ঠিক যে প্রবীণরা নবীনদের মতো খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা দাবা, লুডু, তাস, ক্যারাম, টেবিল টেনিস, ভলিবল খেলতে পারে। প্রবীণদের এসব খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিলে তাঁরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকখানি ভালো থাকার সুযোগ পেত।

শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের মাধ্যমে প্রবীণ জীবনকে সম্মান মর্যাদার সাথে তুলে ধরার জন্য বাজেটে কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। সংস্কৃতির বিকাশে যাঁরা কাজ তাঁরা প্রবীণ জীবনের মর্যাদা, নিরাপত্তা, সুখ সমৃদ্ধির অগ্রাধিকার কতখানি নিজেদের বিবেচনায় রাখেন সেটাও একটা বড়ো প্রশ্ন!

আমাদের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ সাহিত্যে প্রবীণ জীবনকে কতটা মহিমান্বিত করে উপস্থাপন করা হয় সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। বাজেটে এই খাতে যতসামান্য বরাদ্দ দিলে বড়ো ধরনের সুফল বয়ে আনতে পারে।

আবাসন ও নগরায়নে সরকারের বড়ো ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। গত পনের বছরে প্রায় ৭৫০০টি সরকারি ফ্ল্যাট নির্মিত হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নতুন করে আরো ৪৮৫৬টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলছে। বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষদের আবাসন সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে গাজীপুরের টঙ্গীতে ৪০৩২টি ভাড়া ভিত্তিক আবাসিক ফ্ল্যাট তৈরির কাজ চলছে। এসব এলাকায় প্রবীণদের জন্য ভাড়াভিত্তিক ডরমেটরি তৈরি করে আবাসন সংকট নিরসন করা যায়। আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী সংঘের জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে আবাসন সংকট দূর করার প্রস্তাব করছি।

বন্ধ হয়ে যাওয়া নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জ চনপাড়ার পাঁচশ’ শয্যার প্রবীণ নিবাসটি সরকারের নিবিড় তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ দেবার প্রস্তাব করছি।

ব্যক্তিগতভাবে গড়ে ওঠা সকল বৃদ্ধশ্রম, প্রবীণ নিবাস, সিনিয়র হোম, প্রবীণ সেবা কেন্দ্র, কেয়ার সার্ভিস পরিচালনা করতে দ্রুততম সময়ে রেজিস্ট্রেশন দিতে হবে যাতে করে প্রবীণদের দুঃখ দুর্দশা নিরসনে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাঁচ বছরের জন্য কর রেয়াত দেবার জন্য প্রস্তাব করছি।

নির্যাতনের শিকার প্রবীণ নর-নারীর জন্য উপজেলা সমাজ সেবা অফিসে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল গঠন করে শারীরিক, মানসিক ও আইনগত সহায়তা পাবার সুযোগ নিশ্চিত করতে বাজেটে বরাদ্দ দেবার প্রস্তাব করছি।

তথ্য-প্রযুক্তি খাতে গত পনের বছরে ২০ লক্ষ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হয়েছে। বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষম প্রবীণদের তথ্য প্রাযুক্তিতে যুক্ত করে আয় রোজগার বাড়ানো সম্ভব কিনা তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা।

প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রবীণরা তথ্য প্রযুক্তিতে জ্ঞান লাভ করলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, ব্যাংকিং, সংবাদ আদান প্রদান ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে শান্তিতে স্বস্তিতে থাকতে পারবেন।

প্রবীণদের হাতে স্মার্টফোন আছে সেটাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে ভালো কিছু করার সুযোগ তৈরির জন্য বাজেটে বরাদ্দ দিলে ভালো হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের বর্তমান তৈরি করতে প্রবীণদের ভূমিকা ছিল। তাই বাজেটে প্রবীণদের বরাদ্দ বাড়ানো সময়ের দাবি।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষকও সংগঠক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়