প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
কাঙ্ক্ষিত সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে জাতীয় ঐক্য এক অপরিহার্য শর্ত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের ভিত। মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ উত্তরাধিকারী, জনগণের অধিকার ও সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গর্ভে যেমন জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ, ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে, স্বাধীন বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত করতে জন্ম নিয়েছে একটি রাজনৈতিক শক্তি, যার নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।
বামপন্থী ঐতিহ্যের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্তরে স্তরে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান এবং সুমহান জাতীয় মুক্তির আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যুবসমাজ মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গঠনের সংগ্রাম বেগবান করতে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠন করেছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-‘জাসদ’।
জাসদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক, তবে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে কি ডান কিংবা বাম ধারার অনেক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মহল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নানাভাবে যার যেমন খুশি বা সুবিধা তেমন করে উপস্থাপন করে থাকেন। কেউ বলেন এই চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা, কেউ বলেন এই চেতনা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি ধ্বংস করা, কেউ বলেন এই চেতনা মৌলবাদকে নির্মূল করা, আরো বলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা এইগুলো? তবে না, আসলে ঐগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপসর্গ বা উপাদান। আসলে অনেক বামপন্থীসহ জাসদ মনে করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন মানবীয় সমাজ-দেশ গঠন প্রক্রিয়া।
জাসদের জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে, বিপ্লবী পথে। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেক্ষিত ছিল সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাঝে বেড়ে ওঠা সাম্য তথা শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। তখন বিশ্বে চলছিল সমাজতন্ত্র ও জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুরণন। আর বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম ছিল না। বিজয়ী মুক্তি সংগ্রামের পর দেশ গড়ার নীতিতে জাতীয় সরকার গঠনের দাবি যখন প্রত্যাখ্যাত হলো তখন মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম চালিকাশক্তি যুব সমাজের সঙ্গে সরকারের ব্যবধান তৈরি হলো। কোনোরকম সাংগঠনিক পদক্ষেপ বা কর্মকৌশল দিয়েও এই ব্যবধান তদানীন্তন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ দূর করার চেষ্টা করেননি। ফলে জনমনের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে প্রগতিশীল একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম ছিল অবধারিত। একদিকে সরকারের অসহিষ্ণু চাপ, অপরদিকে সনাতনী সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর সাথে আদর্শগত বিতর্ক মোকাবিলা করে ‘জাসদ’কে নিজ পায়ে দাঁড়াতে হয়েছিল।
সমাজের বিবর্তন-চাহিদার সাথে সাথে রাজনৈতিক একটি শক্তি-দলের বিকাশের এ রকম চমকপ্রদ উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে কিন্তু খুব বেশি নেই। সমাজের একদম ভিতর থেকে সমাজের রাজনৈতিক চাহিদা মেটাতে জাসদের জন্ম হয়েছিল। জাসদের জন্মের সাথে কোনো একক ব্যক্তির কৃতিত্ব কিংবা কথিত ষড়যন্ত্রের কোনো সম্পর্ক প্রমাণ করা যাবে না। জাসদ হচ্ছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য থেকে উত্থিত-বিকশিত প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক একটি শক্তি।
আওয়ামী রাজনীতির অভ্যন্তরে যারা নিউক্লিয়াস গড়ে তুললেন, যারা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখলেন, যারা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করলেন, যারা বাংলাদেশের পতাকার নকশা করলেন, যারা সেই পতাকা উড়ালেন, যারা স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করলেন, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন, তারাই কিন্তু জাসদ গঠন করলেন। জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল সাহসী সেসব ব্যক্তিই একটি ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে গঠন করেছিলেন ‘জাসদ’। জাসদের জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা পূরণের জন্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে। বলা হয়েছিল, আমরা লড়ছি শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। এই একটি স্লোগানে ছিল অনেক কথা। কর্নেল তাহেরও তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্যে এই জাসদকেই খুঁজে পেয়েছিলেন এবং আরও অনেকের মত আমি (স্কুল পড়ুয়া)ও খুঁজে পেয়েছিলাম।
মস্কোতে যে সংগঠনের জন্ম হয়, চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যানকে যারা নিজেদের চেয়ারম্যান মনে করেন বা যারা জনবিচ্ছিন্ন বিপ্লবীপনার চর্চা করেন, তাদের বিলুপ্তি বা সমাজে তাদের পক্ষে অকার্যকর থাকা সহজ এবং সম্ভব। কিন্তু জাসদের বিলুপ্তি বা সমাজে অকার্যকর থাকা সম্ভব নয়। বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার সাথে, যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলনে, গণতন্ত্রের সংগ্রামে, স্বৈরাচার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠায় জাসদ হচ্ছে এমন একটি দেশজ প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি, যার জন্ম, বেড়ে ওঠা, ভবিষ্যৎ সবটাই এ সমাজের অন্তঃস্থিত এবং এর মধ্যেই প্রোথিত। এ কারণে এর মূল চেতনাবাহী ধারাটি এখনও জাসদ নাম নিয়েই সক্রিয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
শেষান্তে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এইদিনে দাঁড়িয়ে না বললেই নয়, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কোনো শ্রেণী সংগঠন নয়। বরং প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই একটি সমাজতান্ত্রিক ‘গণসংগঠন’। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কায়েম এর লক্ষ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রের ষড়যন্ত্র ও অপরিমেয় অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন-খুন সহ্য করতে হয়েছে এই দলকে। আমরা হারিয়েছি হাজার হাজার সাথীকে, বারবার নিষিদ্ধ হয়েছে দলের কার্যক্রম। দলের মধ্যে ভিন্নমতের কারণে অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন, অনেকে দলত্যাগ করে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন, অন্য দল গঠন করেছেন। তারপরও দলের মূলধারা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার দল হিসেবে আমরাই কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি এবং আশান্বিত, সমাজবদলের তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্বের সম্ভাবনার জায়গাটা জাসদীয় ঘরানা থেকেও সৃষ্টি হতে পারে।
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।