বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

জন্ম থেকে জ্বলছি
বিমল কান্তি দাশ

জন্মেছি ব্রিটিশ ভারতের ত্রিপুরা জেলা বর্তমানে চাঁদপুর জেলা (ঐক্যে চাঁদপুর মহকুমা)-এর অতি নিভৃত পল্লী সন্না গ্রামে ১৯৪২ সালের ১০ এপ্রিল। শৈশবে বাবার কাছে শুনেছিলাম, ব্রিটিশ শাসিত ভারত নির্বিঘ্নে শাসন করার জন্য যে দুটি বিষবৃক্ষের বীজ উপ্ত হয়েছিল তা হলো লর্ড কার্জনের ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব এবং অপরটি ১৯৪০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র দ্বি-জাতিতত্ত্ব। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোরব বড় লাট লর্ড কার্জনের আদেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করে পূর্ববঙ্গ (বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবঙ্গ (ভারতেরই অঙ্গরাজ্য) সৃষ্টি হয়। আর দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষক্রিয়ায় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে দুটি স্ব-শাসিত দেশ ভারত ও পাকিস্তান মূলত জন্মলাভ করে। ভারত বর্তমানে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র হিসাবেই রয়ে গেল। কিন্তু পাকিস্তান অধিরাজ্য বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত। তবে পূর্ব পাকিস্তান (স্বাধীন বাংলাদেশ) বিয়োজিত। বিভাজনের চূড়ান্ত ফলাফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভূ-স্বর্গ কাশ্মির প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে পরস্পর মারাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।

এখন থেকে ৭৫ বছর আগে যুক্ত ভারত থেকে পাওয়া স্বাধীনতায় উপমহাদেশে জন্ম নেয় দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান। অব্যবহিত পরেই শুরু হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এতে দেড় কোটি নিরীহ মানুষ বাস্তুহারা হন, সহিংসতায় প্রাণ হারান প্রায় ১০ লাখ মানুষ। ওই বিভাজনের পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান পরস্পর চির শত্রুতে পরিণত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় কূটনীতির প্রয়োজন, কিন্তু ধর্মের মধ্যে আপেক্ষিক কোনো তত্ত্ব কাজ করে না--ধর্ম অত্যন্ত পবিত্র। কিন্তু ধর্মাশ্রিত জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করেই মূলত ভারত-পাকিস্তান জন্মলাভ করেছে। এটা ক্ষমতাশ্রিত হওয়ার কূট কৌশল মাত্র। পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু পর্যন্ত যে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ করেছি, তার সামাজিক চিত্র-প্রশাসনিক চিত্র-রাজনৈতিক চিত্র-শিক্ষা-স্তরচিত্র এবং স্থানীয় সরকারের যে কদাকার চিত্র তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। তখন দেশে আয়ুব শাহীর কুখ্যাত মৌলিক গণতন্ত্র চালু ছিল। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তখন ওয়ার্ড মেম্বারগণের পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতো। আবার এই বেসিক ডেমোক্রেটরাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটার। এর মধ্যে ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ৬-১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এরপর ১৯৬৯ সালে শত্রু-সম্পত্তি আইন তড়িঘড়ি করে প্রণয়ন এবং পাস করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে দেয়। এর সাথে যুক্ত হয় সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং বিতরণের অপর একটি কুৎসিৎ কূটকৌশল। অজ্ঞাত পরিচয়ের কাউকে ভারত থেকে বিতাড়িত রিফিউজি সাজায়ে সংখ্যালঘুদের বাড়ির খালি জায়গায় ঘর তুলে দিতো এবং সুযোগ বুঝে সাজানো রিফিউজিদেরকে উৎখাত করে স্থানীয় কথিত প্রভাবশালীরা নিজেরাই দখল করে নিতো। এ ব্যাপারে প্রতিকারের জন্যে প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেই বিভিন্ন ধরনের অশ্রাব্য কটুক্তি শুনতে হতো। এমনি ভাবেই কেটেছে আমাদের শৈশব-বাল্যকাল-কৈশোর এবং প্রারম্ভিক যৌবন। এ দেশে থাকতে পারা বা না পরার এক অশনিসংকেত আমাদেরকে তাড়া করতো। তখন আমাদের জন্যে শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় যাওয়া যেতো না। সে যুগের শিক্ষকতা আর এ যুগের শিক্ষকতার মূল্যায়ন নিতান্তই হাস্যকর। ’৬৯-এর অপ্রতিরোধ্য গণআন্দোলন, ’৭০ সালের উত্তপ্ত পরিস্থিতি আর ’৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে নরপশু পাকসেনাদের বিধ্বস্ত করার দৃশ্য আমাদেরকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে।

দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় এক সময় কতিপয় বিপথগামী সৈনিক কর্র্তৃক বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেশে কতগুলো প্রতি বিপ্লবে অনেক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয় এবং এই সোনার বাংলা একাধিক অদক্ষ শাসকের প্রণীত সামরিক গণতন্ত্র দ্বারা বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ভর্তি বাণিজ্য এমন এক ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল, যাতে আমরা সাধারণ অভিভাবকবৃন্দ শিক্ষা ক্ষেত্রে সন্তানদেরকে যথোপযুক্ত শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হই। নদীর ¯্রােতধারা আর জীবনের মহাকালতো সমধর্মী। সে জ্বালায় আজও জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি--এ যেন এক অভিশপ্ত কালের গণ্ডি।

একটা পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলেই প্রকৃত বিবেকবানদের ধারণার সুস্পষ্টতার উদয় হবে। তা হলো ডিজিটাল মোবাইলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের সংখ্যার ক্রমাবনতির হার--১৯৪৭ সালে ৩১%, ১৯৫১ সালে ২২.৭%, ১৯৬১ সালের ১৮.৫%, ১৯৭৪ সালে ১৪.৬%, ১৯৮১ সালে ১২.১%, ১৯৯১ সালে ১০.৫%, ২০০১ সালে ৯.২%, ২০১১ সালে ৮.৫%, ২০২২ সালে ৭.২%। প্রিয়া সাহার দেয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ১৯৪৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অধিকাংশ হিন্দু অত্যাচারিত হয়েই দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। এদের সংখ্যা তিন কোটিরও ঊর্ধ্বে। এটা বাংলার চিরন্তনীয় সহমর্মিতার পরিপন্থী বটে। যে খেদোক্তি মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিমের কলমে আঁকিছে :

যে জন বঙ্গে জন্মে হিংসে বাঙ্গবাণী।

সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন’জানি॥

সমস্বরে বলতে হয় :

স্বৈরাচারী আয়ুবের কালাকানুন তফসিলের নামান্তরে চালু আছে বাংলায়, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মাহুতিতে এই ভ্রুকুটির লেশ বাংলাতে মানায়?

বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়