শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

আমরা ইকো-টেররিজমের শিকার হচ্ছি কি না
অনলাইন ডেস্ক

২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া একটি বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র সম্প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। পরিবেশ দূষণ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা এই ছবিতে দেখানো হয়েছে। চলচ্চিত্রের একেবারে শেষের দিকে ‘ইকো-টেররিজম’ বা পরিবেশ-সন্ত্রাসবাদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই শব্দটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ, বর্তমানে পুরো বিশ্ব পরিবেশ দূষণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

চলচ্চিত্রে দেখানো হয়, একটি অসৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিতর্কিত ‘রিভার্স বোরিং’ পদ্ধতিতে তাদের শিল্পবর্জ্য নিষ্কাশন করে। ফলস্বরূপ, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং ক্রোমিয়ামের মতো ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ ওই এলাকার পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফল হয় ভয়াবহ! সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রটি ফিকশনাল। ছবির শুরুতেই বলা হয়, ‘এই ছবিতে চিত্রিত সমস্ত চরিত্র, কার্যকলাপ, স্থান, নাম, পরিস্থিতি এবং ব্যক্তি (জীবিত বা মৃত) কাল্পনিক’। তবে ছবির শেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে এবং তখনই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘আমরা কি নিশ্চিত যে, আমরা ইকো-টেররিজমের শিকার নই?’

ঊনিশ শতকের শিল্প-বিপ্লবের পরে, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো সারা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠে। শিল্পায়নের চূড়ান্ত লক্ষ্য মানব সভ্যতার বিকাশ এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। কিন্তু, যখন বেপরোয়া শিল্পায়ন পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এবং বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট করে, তখন শিল্পায়ন তার লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। বরং তখন তা মানুষের অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ফেলে। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর মার্কিন তাত্ত্বিক, ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক নোম চমস্কি বলেছিলেন, ‘আমরা করোনাভাইরাস সংকট কাটিয়ে উঠবো, তবে আমাদের সামনে আরও মারাত্মক সংকট রয়েছে’।

সমগ্র বিশ্বেই একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, বেশির ভাগ শহর এবং শিল্পস্থাপনা নদীর তীরে বা কাছাকাছি অবস্থিত। বর্তমান বিশ্বে নগরায়ন ও শিল্পায়নের যে কাঠামো বিদ্যমান তাতে বিভিন্ন শিল্পবর্জ্য, যেমন কঠিন বর্জ্য, শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং অন্যান্য বিষাক্ত বর্জ্য যথাযথ পরিশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশে নিষ্কাশন করতে পারছে না! ফলস্বরূপ নগরায়ন ও শিল্পায়ন এলাকায় জলধারার বিশুদ্ধতার মান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এবং এ সকল বর্জ্য মানুষের অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি হয়ে উঠছে।

আমরা জানি, পানি দূষণের দুটি প্রধান উৎস রয়েছে, পয়েন্ট সোর্স এবং নন-পয়েন্ট সোর্স। কারখানা, পাওয়ার প্ল্যান্ট, স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলোকে পানি দূষণের পয়েন্ট সোর্স হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, সাধারণত এ সকল প্ল্যান্ট পাইপের মাধ্যমে দূরবর্তী স্থানে বিষাক্ত পদার্থ নির্গত করে, যা নদী বা পানির উৎসকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফি বলছে যে, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সত্তর ভাগ শিল্পবর্জ্য পানিতে অপসারণ করা হয়, যা ব্যবহার উপযোগী পানির উৎসকে দূষিত করে। এসব দেশে গড়ে প্রতি বছর বাইশ মিলিয়ন টন সার এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়’ (ন্যাশনালজিওগ্রাফিক.কম)। বর্তমানে দূষিত পানি বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে জীবনযাত্রার মান এবং জনস্বাস্থ্য উভয়কেই হুমকির মুখে ফেলেছে। কোলন ক্যান্সার, হাঁপানি, কিডনি সমস্যা, মাতৃস্বাস্থ্য সমস্যা, ডায়রিয়া এবং অন্যান্য অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার সরাসরি কারণ হচ্ছে শহরকেন্দ্রিক পানি দূষণ।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ এবং এদেশের মধ্য দিয়ে (উপনদীসহ) প্রায় ৭০০ নদণ্ডনদী প্রবাহিত হয়েছে। নদী পরিবেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা স্বাদুপানি ধারণ করে এবং পৃথিবীতে পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য বজায় রাখতে অভাবনীয় ভূমিকা রাখে। কিন্তু, বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী, বিশেষ করে শহরের নিকটবর্তী নদীগুলোতে বিভিন্ন শিল্পবর্জ্য কোনো রকম শোধনব্যবস্থা ছাড়াই নিঃসরণ করে নদীর পানি দূষিত করা হচ্ছে।

কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার হচ্ছে নদীগুলো। এখানে যত্রতত্র সীসা, ক্যাডমিয়াম, লোহা, তামা এবং জৈব-বর্জ্যরে মতো দূষণকারী রাসায়নিক পদার্থসহ পয়ঃনিষ্কাশন বর্জ্য অহরহ নদীতে ফেলা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ভয়ঙ্করভাবে পানির বিশুদ্ধতা এবং পানিতে বসবাসকারী বিভিন্ন জলজ প্রজাতির বেঁচে থাকাকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে। এছাড়াও এ সকল পদার্থ পানির মধ্যে বায়ু চলাচল ব্যবস্থা এবং নদীগুলোর স্ব-পরিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করছে। ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদী ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি দূষণের একটি যথার্থ উদাহরণ।

‘বিশ্ব পানি দিবস-২০১৯’ উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ঢাকা শহরের চারপাশের নদীর পানিকে নিয়মিতভাবে দূষিত করছে ১৪৮টি উৎস। এসব উৎস থেকে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, রেডি-মিক্স, পয়ঃনিষ্কাশন বর্জ্য, শিল্পবর্জ্য এবং হাট-বাজারের বর্জ্য। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের বর্জ্য পাইপের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে ফেলে (দৈনিক যুগান্তর, ২২ মার্চ ২০১৯)।

আমাদের একটি অভ্যস্ততা যে, আমরা আমাদের যে কোনো সমস্যা চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত সমাধান করতে পারি না। আমাদের একটি নেগেটিভ প্রবণতা হচ্ছে, সাধারণত যখন কোনো বিষয় চূড়ান্তভাবে খারাপ হয় তখন আমরা সে সম্পর্কে সচেতন হই। উদাহরণস্বরূপ, ট্যানারি শিল্পকে স্থানান্তরিত করতে আমাদের এক যুগেরও অধিক সময় লেগেছে এবং এর মধ্যে ট্যানারি বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীর জলজ প্রাণী ও বায়ো-ডাইভারসিটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। অথচ এই নদীটি ছিল ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগস্থ পানির প্রধান উৎস।

স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত আমরা যা অর্জন করেছি তার জন্য আমাদের অবশ্যই গর্বিত হওয়া উচিত। কিছুদিন আগেই আমরা উদ্বোধন করলাম স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এছাড়া মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন টানেল নির্মাণ এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।

দেশের এতসব উন্নয়নে শিল্পের অবদান আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। কিন্তু, আমাদের মনে রাখা উচিত, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন পরিবেশের জন্য বিরাট ক্ষতিকর এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি হবে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের টেকসই ব্যবস্থাপনায় চরম অপরিণামদর্শিতা। কারণ, প্রায় প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে শোষণ করে এবং নানাভাবে পরিবেশ দূষণকে ত্বরান্বিত করে।

প্রথমেই যে চলচ্চিত্র নিয়ে শুরু করেছিলাম, তা দিয়েই শেষ করি। ছবির শেষের দিকে একটি সত্য ঘটনার উল্লেখ আছে : ১৯৬০ সালে পাঞ্জাবে সবুজ বিপ্লব শুরু হয়। রাসায়নিক দূষণের কারণে ২০১৬ সালে এটি ভারতের ক্যান্সার-বেল্ট হিসেবে পরিচিতি পায়। লুধিয়ানা (পাঞ্জাবের একটি জেলা)-এর আশেপাশে ১৩৩২ ধরণের বিপজ্জনক বর্জ্য তৈরি করা হতো। সেখানে বছরে প্রায় সাত লাখ মানুষ ক্যান্সারে মারা যায়। গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের চেয়ে রাসায়নিক দূষণের কারণে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের নতুন রূপ এখন ‘ইকো-টেররিজম’ (চলচ্চিত্র ইরাদা, ভাষা হিন্দি, মুক্তি ২০১৭)।

পরিবেশের অনেক উপাদান রয়েছে, তার মধ্যে নদী এবং পানি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পানি শুধুমাত্র মানুষের বেঁচে থাকার জন্যই প্রয়োজনীয় নয়, পশুপাখি, গাছপালা এবং অন্যান্য সকল জীবের জীবন ধারণের জন্যও অপরিহার্য। পানির সহজলভ্যতা এবং প্রবাহ সবসময়ই সভ্যতা ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ গতিপথ নির্ধারক। কিন্তু এটা দুঃখজনক যে, এতো গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও পানি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা সম্পদ!

বর্তমানে পানি দূষণ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি। অধিকাংশ দেশেই দূষিত পানি মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং জনস্বাস্থ্য উভয়কেই মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশুদ্ধ পানির ওপরই নির্ভর করতে হবে। কাজেই সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে এটা আমাদের জানানো জরুরি যে, আমরা ইকো-টেররিজমের শিকার হচ্ছি কি না।

নজরুল ইসলাম : লেখক, এমফিল গবেষক (ভাষা শিক্ষা) ও সহযোগী বার্তা সম্পাদক, দ্য বাংলাদেশ এক্সপ্রেস। ই-মেইল : [email protected] ও ফেসবুক @nayrul.russell

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়