প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২২, ০০:০০

আল্লাহ তা’য়ালার সুস্পষ্ট ঘোষণা, সমগ্র মানবতার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনব্যবস্থা হলো ‘ইসলাম’। জীবনের সবদিক ও বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে এমন এক অনন্য, দীপ্তিময় জীবনবিধান আল্লাহ তা’য়ালা দিয়েছেন। যার মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই, কমতি নেই। নেই কোনো অপূর্ণাঙ্গতা। এজন্যে, যে এই ‘দ্বীন’ তথা জীবনবিধান অনুসরণ করবে; অন্য কোনো বিধি-বিধান বা রীতি-নীতির প্রতি অনুরক্ত হওয়া তার জন্যে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়-অগ্রহণযোগ্য। বরং একজন মুসলমান কালিমা তাইয়্যেবাহ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ পড়ে যে মাত্র নিজেকে আল্লাহর জন্যে সঁপে দিয়েছে তখন থেকেই শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত জীবনের প্রতি কদমে তার অনুসরণীয় বিষয় হলো ইসলাম। উল্লেখ্য সময় হলো মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। জীবনের অন্যতম মূল্যায়নযোগ্য বিষয় হলো সময় তথা দিন-তারিখ ও বছর গণনা। অধিক গুরুত্বের কারণে আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনুল কারীমে ‘কাল’ তথা সময়ের শপথ করেছেন। সময়ের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দণ্ডউৎসব এবং আমাদের মূল্যবান ইবাদত-বন্দেগী। এজন্য প্রত্যেক মুসলমানের লক্ষ্য করা উচিত, যেনো এই মূল্যবান সময়ের গণনা একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর সম্মানিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নির্দেশিত পন্থায় হয়। আফসোস হলো সিংহভাগ মুসলমান দিন-তারিখ গণনার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় সভ্যতায় বুঁদ হয়ে আছে। পুরানো গ্লানিকে মুছে দিয়ে, হতাশার আঁধার কাটিয়ে, আশায় বুক বাঁধতে নতুন বছরকে বরণ করতে হলেও মুসলমানকে ফিরতে হবে তার শেকড়ে তথা ইসলামি ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিতে। একে গুরুত্ব না দেয়া মানে মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।
প্রত্যেক জাতি, গোষ্ঠীর বর্ষ গণনার ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম রয়েছে, যা তাদের জাতিগত ঐতিহ্যের ধারক। ইসলামেরও একটি সন আছে, গণনার পদ্ধতি আছে, মাস ও বছর হিসাব-নিকাশের মানদণ্ড আছে। যেটাকে ‘হিজরি সন’ বলা হয়। চাঁদকে কেন্দ্র করে এটি আবর্তিত হয় বিধায় একে ‘চন্দ্র সন’ও বলে। মূলত এটি হচ্ছে ‘ইসলামি সন’ বা ‘ইসলামি বর্ষ’। একজন মুসলমানের জীবনে হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ হিজরি সন এমন একটি সন, যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, এবাদত, দ্বীন-ধর্ম ও গৌরবের ভিত্তি সম্পৃক্ত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম উম্মতকে প্রতিটি দিবসের আগমনে বিভিন্ন দোয়া-তাসবীহ ইত্যাদির মাধ্যমে স্বাগত জানানোর শিক্ষা দিয়েছেন, তেমনি প্রতিটি চান্দ্রমাসের আগমণে নবচাঁদ দেখে নতুন মাসকে আল্লাহর প্রশংসাসূচক দোয়া দ্বারা অভ্যর্থনা জানানোর তালীমও দিয়েছেন। সেই হিসেবে আরবি নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানো তথা ‘হিজরি নববর্ষ’ উদ্যাপন করা শরীয়াহসম্মত বিষয়। নিজেদের অতীত গৌরবকে স্মরণ ও অনুধাবনের লক্ষ্যে ব্যাপক সমারোহে ‘হিজরি নববর্ষ’ পালন করাটা সময়ের দাবি। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ৯১ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলিম সংস্কৃতির এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত। আমরা বেশির ভাগই খবর রাখি না কখন হিজরি সন শুরু হয় কিংবা শেষ হয়। ইংরেজি বর্ষের মাস-তারিখ সবার জানা থাকলেও আমাদের মূল হিজরি সনের কোন্ মাসের কত তারিখ যাচ্ছে তা জানি না, জানার চেষ্টাও করি না! বাংলা এবং ইংরেজি নববর্ষে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা, অনুষ্ঠান, লেখালেখি হয়, অথচ মুসলমানের দেশে ‘হিজরি নববর্ষ’ নিয়ে তেমন কোনো আয়োজন চোখে পড়ে না। উম্মাহর অতীত গৌরবকে স্মরণ করার এমন একটি অনন্য উপলক্ষ গুরুত্বহীন হয়ে পড়া আমাদের জন্যে আত্মঘাতী হওয়ার নামান্তর। কারণ বর্তমান প্রজন্ম বিজাতীয় অপসংস্কৃতির উন্মাদনায় বেসামাল। তাদেরকে ‘হিজরি নববর্ষ’ সম্পর্কে জানানো সময়ের বিবেচনায় অতীব জরুরি।
ইসলামপূর্ব যুগে সন-তারিখ গণনার জন্যে আরবদের নির্দিষ্ট কোনো নিয়মণ্ডকানুন ছিলো না। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘দিনপঞ্জি’ গণনা করতো তারা। যেমন : আবরাহা কর্তৃক কা’বা ঘর আক্রমণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘আমুল ফিল’ বা হস্তীসন গণনা করা হতো। আবরাহার হস্তী বাহিনী আবাবিল পাখির প্রস্তর নিক্ষেপের ফলে যেদিন ধ্বংস হয়েছিলো, সেদিনকে সমগ্র আরববাসী গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাথমিক চল্লিশ বছর বয়সকাল পর্যন্ত আবরাহা ও তার হস্তী বাহিনীর ধ্বংসের ঘটনাটি সন গণনার মানদণ্ড ছিলো। কখনো কখনো ‘ওকাজের মেলা’কে সময় গণনার দিন চিহ্ন করা হতো। অর্থাৎ গণনার জন্যে সুস্পষ্ট একক কোনো পদ্ধতি আরবদের মধ্যে ছিলো না। তবে চান্দ্র মাসের হিসাব ছিলো। এর মধ্যে চারটি মাস ছিলো আরবদের মাঝে অতি সম্মানিত। কিন্তু দিন গণনা এক কথা এবং কাল নির্দেশনা অন্য কথা। এ কাল নির্দেশনার সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে মদিনা শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার হিজরত করার মাধ্যমে। যদিও মদিনায় হিজরতের মধ্যে দিয়ে আরব মুসলমানদের মাঝে এক অভিনব সাল গণনার পদ্ধতি চালু হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানের মতো এটি সুসংগঠিত রূপ পেতে অনেক সময় লেগেছে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় এবং হযরত আবু বকর ছিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফতকালে হিজরি সালের ব্যবহার আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি। পরে ক্রমে ক্রমে ইসলামি খেলাফতের পরিধি বাড়তে থাকলে এর কার্যক্রমও বহুমুখী বিস্তৃত হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ফরমান কার্যকরি করতে গিয়ে সন-তারিখের অভাবে অসুবিধা অনুভূত হয়। বিশেষ করে আমীরুল মোমেনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আল ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে ইসলামি রাষ্ট্রের প্রসারতা আরব-আজম সর্বত্র দ্রুতগতিতে হতে থাকে। তিনি সুবিশাল ‘খেলাফতে ইসলামিয়্যাহ’ পরিচালনার সুবিধার্থে রাষ্ট্রকে বিভিন্ন অঞ্চল-প্রদেশে বিভক্ত করেন। রাজধানী ‘মদিনাতুল মুনাওয়ারাহ’ থেকে প্রতিনিয়ত অজস্র চিঠি, ফরমান ও নির্দেশনা প্রদেশগুলোতে পাঠানো লাগতো, আবার আঞ্চলিক প্রদেশসমূহ থেকে আগত অনেক পত্রও গ্রহণ করতে হতো। খেলাফতের তৃতীয় বা চতুর্থ সনে বিখ্যাত সাহাবী ইরাক ও কুফার প্রশাসক হযরত আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি চিঠি খলিফার নিকট এসে পৌঁছে। যাতে তিনি খলিফাতুল মুসলেমিনকে লক্ষ্য করে লিখেছেন, ‘আমিরুল মুমিনীন! আপনার পক্ষ হতে আসা শাসনকার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশসম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোনো সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারনে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সাথে পার্থক্য করা আমাদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে যেয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।’ [ফাতহুল বারী, খণ্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ২০৯, তারীখে তাবারী]। অতঃপর ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু সিনিয়র সাহাবা ও জ্ঞানী-গুণীদের নিয়ে জরুরি পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। সমস্যা সমাধানে মুসলিম উম্মাহর জন্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটি সন-তারিখ গণনার পদ্ধতি নিয়ে সকলের মতামত জানতে চান। বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত দিলেও শেরে খোদা হযরত মাওলা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের পবিত্র হিজরতকে কেন্দ্র করে মুসলিম সন প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। সবার সম্মতিতে ফারুকে আজম ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু এ প্রস্তাব সমর্থন করেন ও হিজরতের ১৬ বা ১৭তম বছরে রাষ্ট্রীয় ফরমানের মাধ্যমে ‘মহররম’ মাস থেকে মুসলমানদের নতুন বছর তথা ‘হিজরি সনের’ আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সূচনা করেন। [আল মুসতাদরাক, ইমাম হাকেম (রহঃ), বিদায়াহ নেহায়াহ, ইমাম ইবনে কাছির (রহঃ)]। নবীয়ে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরত রবিউল আউয়াল মাসে হলেও যেহেতু মহররম মাসে তিনি হিজরতের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন এবং সার্বিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছিলো তাই এই মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে ধার্য করা হয়।
হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সনের সাথে মুসলমানদের ইতিহাস ও ইবাদতকেন্দ্রিক অনেক বিষয় জড়িত। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। (সূরা আল-তাওবাহ : ৩৬)।
মহান আল্লাহ আরও এরশাদ করেন, ‘হে হাবীব! আপনার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। আপনি বলে দিন, এটি মানুষের জন্যে সময় নির্ধারন এবং হজের সময় ঠিক করার মাধ্যম। (বাকারাহ : ১৮৯)।
অন্যত্র আরও এরশাদ করেন, ‘তিনিই সে মহান সত্তা, যিনি বানিয়েছেন সূর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে ¯িœগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্যে মনযিলসমূহ, যাতে করে তোমরা চিনতে পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ এই সমস্ত কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি, কিন্তু যথার্থতার সাথে। তিনি প্রকাশ করেন লক্ষণসমূহ সে সমস্ত লোকের জন্যে যাদের জ্ঞান আছে।’ (সূরা ইউনূস : আয়াত ৫)।
এ সকল আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তা’য়ালা চন্দ্র-সূর্য, ১২টি মাস সৃষ্টি করেছেন বান্দাদের সন-তারিখণ্ডসময় হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে। আর হিজরি সন চন্দ্রকেন্দ্রিক আবর্তিত হয়। চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্তে দিন-রাত্রির আগমন-প্রস্থান, ৩০ দিনে মাস, ১২ মাসে ১ বছর এসবই আল্লাহ তা’য়ালার নিদর্শন। তাহলে বোঝা যায়, হিজরি সন আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক নির্দেশিত। ‘হিজরি নববর্ষ’ প্রতি বছর মহান রবের এই চমৎকার নিদর্শনকে অনুধাবন ও আল্লাহর নির্দেশ সময়কে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার বারতা নিয়ে আগমন করে।
মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারেও হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরি সন শুরু করার কারণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদিনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুসলিমদের শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
হিজরি নববর্ষ উদ্যাপন মুসলিম উম্মাহকে মনে করিয়ে দেয় প্রিয় নবী রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে সুদূর মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে। বস্তুত রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সেই ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিবাহী হচ্ছে হিজরি সন। এ হিজরতের মধ্য দিয়েই ইসলাম এক নবশক্তি লাভ করেছিলো। এতোদিন পর্যন্ত মুসলমানরা কেবল আত্মরক্ষাই করে এসেছে, মুখবুঝে জুলুম অত্যাচার সহ্য করে এসেছে। অবশেষে হিজরতের মধ্য দিয়ে এতো সব জুলুমণ্ডঅত্যাচারের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষমতা তাঁদের অর্জিত হয় এবং রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। হিজরত-পরবর্তী সময়ে মুসলমানরা ক্রমেই সুসংহত ও সম্প্রসারিত হয়েছে। ইসলাম বিশ্বজনীন রূপে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। ইসলামের অবদানে বিশ্ব সভ্যতা সমৃদ্ধশালী হয়েছে। এক সময়ে মুসলমানরা বিশ্বের এক অজেয় শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাকে অবিস্মরণীয় অবদানে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলো। তার শুভসূচনা এ হিজরত থেকেই।
হিজরতপূর্ব প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের ন্যায় বর্তমানেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানগণ ইহুদী-খ্রিস্টান-হিন্দু ও বিজাতীয়দের হাতে নিপীড়িত, নিগৃহিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সে সময়কার মুসলমানদের ন্যায় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে সুসংহত হয়ে নিজ পায়ে ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। বলাবাহুল্য, হিজরি নববর্ষ উদ্যাপন মুসলিম উম্মাহর নবচেতনা জাগ্রতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
হিজরতের দ্বারা হযরত আবু বকর ছিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু, অন্যান্য সাহাবাগণের এবং মুসলমানদের ধর্মীয় গাম্ভীর্য ও রাসূলপ্রেম ফুটে উঠে। তাই বলা যায়, ‘হিজরি সনের নববর্ষ পালনের মধ্যে রাসূলপ্রেমের বিষয়টিও আছে, যা ঈমানের মূল। ‘হিজরি সন’ মুসলিম উম্মাহর একক শেয়ার বা গৌরবজনক স্মৃতির বাহক। হিজরি নববর্ষ পালনের মাধ্যমে নিজেদের অতীত ইতিহাসের পুনরালোচনা হয়, ইসলামের বিশ্বজয়ী গৌরবযাত্রার স্বর্ণালি স্মৃতি রোমন্থন করে ঈমানি চেতনা ও উৎসাহ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। যারা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে উদাসীন তাদের বিশ্বাস ও চেতনায় দুর্বলতা তৈরি হয়। হিজরি নববর্ষ পালনের দ্বারা অতীতের সোনালি ইতিহাসের সাথে আত্মিক একটা সংযোগ তৈরি হয়।
মুসলমানদের জীবনে রোজা-হজ, দুই ঈদ, শবে বরাত, শবে কদর, শবে মেরাজ, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আশুরা, আরাফার রোজাসহ বিভিন্ন বিষয়ের বিধি-বিধান হিজরি সনের উপর নির্ভরশীল। এমনকি ইসলামের পঞ্চবেনার অন্যতম জাকাত দেয়ার জন্যেও বাৎসরিক হিসাবের ক্ষেত্রে ‘হিজরি সন’ অনুসরণ করতে হয়। হিজরি সাল ৩৫৪ দিনে আর খ্রিস্টীয় সাল ৩৬৫ দিনে। হিজরি সন অনুযায়ী গণনা করলে খ্রিস্ট সালের ১১ দিন পূর্বেই জাকাত ফরজ হয়ে যায়। এতে উম্মাহর হাজার হাজার কোটি টাকা জাকাত খাতে প্রদানের সুযোগ হয়। এছাড়াও কোনো নারী তালাকপ্রাপ্তা হলে তার ইদ্দত হিসাবের জন্যেও হিজরি সনের তারিখণ্ডমাস মেনে চলতে হয়।
রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ তথা শুভাগমন, মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত, কেবলা পরিবর্তন, বদর যুদ্ধ, ওহুদ যুদ্ধ, রমজানের রোজা ফরজ হওয়া, হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয়সহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় দিনগুলোর আলোচনা করতে হলে সন-তারিখ জানা জরুরি। ইতিহাসের কিতাবগুলোতে হিজরি সন অনুযায়ীই এসবের দিন-তারিখণ্ডমাস দেয়া আছে। আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রায় সবকিছুই হিজরি সন অনুযায়ী ঐতিহাসিকগণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই হিজরি নববর্ষ উদ্যাপন কেবলমাত্র একটি অনুষ্ঠানই নয়, বরং অতীতের সাথে বর্তমানের মিলবন্ধনের উপলক্ষ। মুসলিম জাতিসত্তার হারাসম্বিত ফিরে পেতে একটি প্রেরণার উৎস। আলহামদুলিল্লাহ, ১৪৪৩ হিজরি সন বিদায় নিয়ে ১৪৪৪ হিজরি সনের শুভাগমন ঘটেছে। ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস পবিত্র ‘মহররম’ আমাদের মাঝে আগমন করেছে। আসুন, ‘হিজরি নববর্ষ’ পালনের মাধ্যমে ইসলামি চেতনাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিই। অতীতের ভুল- ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে আল্লাহর কাছে তওবা করি। ‘হিজরত’ মানে ত্যাগ করা। ভোগ নয়! মুমিনের জীবনের পরতে পরতে ত্যাগ-তিতিক্ষার দাবি নিয়ে হিজরি নববর্ষ আবারও এসেছে। সমস্ত অন্যায়, অপসংস্কৃতি, জুলুম পরিত্যাগ করি। হিজরি নববর্ষ পালনের মাধ্যমে ইসলামি সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার ঘটাই। মহররমের ১০ তারিখ কারবালা প্রান্তরে রাসূলদৌহিত্র ইমামুশ শোহাদা ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তার সঙ্গী-সাথীদের সর্বোচ্চ কোরবানি ও এর শিক্ষাই হোক উম্মতের ভবিষ্যৎ জীবনের পথনির্দেশক। আমিন! বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন। [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ-লিহি ওয়াসাল্লাম]।
আবুল হাসান মোহাম্মদ বায়জীদ : আরবি প্রভাষক, ধানুয়া ছালেহিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।