প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
অংশগ্রহণকারী সকলের প্রায় শতভাগ সন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে গত ২ থেকে ৬ মার্চ (বৃহস্পতিবার রাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত) চাঁদপুর প্রেসক্লাবের ২০২৩ সালের আনন্দ ভ্রমণ সম্পন্ন হয়েছে।
এবার গন্তব্য ছিলো পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও সমুদ্র সৈকতে ঋদ্ধ কক্সবাজার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কিংবা দলগতভাবে সকল আনন্দ ভ্রমণ সাধারণত পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় না। সে আলোকে বলা যায়, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের এবারের আনন্দ ভ্রমণটি অনেক বেশি উপভোগ্য হয়েছে। ভ্রমণকালীন আনন্দ ভ্রমণের মধ্যে নিরানন্দ যেটা ছিলো, সেটা হচ্ছে সেক্রেটারী আল ইমরান শোভনের অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতি।
প্রেসক্লাবের সভাপতি এএইচএম আহসান উল্লাহর নেতৃত্বে ২ মার্চ মধ্যরাতের কিছুটা পূর্বে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে পদ্মা নামের তিনটি বাসযোগে যাত্রা শুরু হয়। পূর্বে বাসে আসন বরাদ্দ নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কারো কারো আপত্তি উত্থাপনের প্রবণতা দেখা গেলেও এবার টু-শব্দটিও হয়নি। কারণ প্রতিটি বাসের পেছনের দু সারি খালি রেখে জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায় অংশগ্রহণকারীদের আসন বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়। সকাল ৮টার মধ্যে ভ্রমণ দলটি পৌঁছে যায় বান্দরবান জেলা সদরের ৭ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত নাইট হেভেন নামের আবাসিক হোটেলে। এক নজরে ছয় তলা বিশিষ্ট এই হোটেলটি সকলের পছন্দ হয়। দক্ষিণমুখী বারান্দায় সুপরিসর এ হোটেলের রুমগুলোতে যারাই থাকার সুযোগ পেয়েছেন, তারাই স্বস্তিবোধ করেছেন। পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত হোটেলের সামনে গাড়ি রাখার প্রশস্ত জায়গা, তার মধ্যে ফুটন্ত ফুলগাছ ও ক্যাপসুল লিফটের কারণে হোটেল ভবনের বাহ্যিক সৌন্দর্য ছবি তোলার উপযোগিতায় ভরপুর। সেজন্যে কাউকে কাউকে ভ্রমণক্লান্তি নিরসনে হোটেলরুমে গা এলিয়ে দেয়ার পরিবর্তে ছবি তোলার ব্যস্ততায় সময় পার করতে দেখা যায়।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক থেকে যে সড়কটি বান্দরবান জেলা সদর অভিমুখে পাহাড় ভেদ করে গিয়েছে, সেটি আগের ন্যায় অপ্রশস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নেই। আগে বান্দরবানের পাহাড়ি সড়ক থেকে গাড়ি নিচে পড়ে প্রায়শ দুর্ঘটনা ঘটার যে বদনাম ছিলো, সেটি এখন অনেক কমেছে বাঁকসহ পুরো সড়কটি সুপ্রশস্ত করার কারণে। সড়কটির ঝকঝকে তকতকে অবস্থা দেখলে মনে হয়, এটি বুঝি বাংলাদেশের কোনো রাস্তা নয়। হোটেল নাইট হেভেন এই সড়কটির এমন সৌন্দর্যপূর্ণ বাঁকে অবস্থিত, যা দৃষ্টিতে দেয় শান্তি, মনে জাগায় পুলক।
নাইট হেভেন হোটেলটির অবস্থান ও সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণা দিয়ে এতে প্রয়োজনীয় রুমের বুকিং নিশ্চিত করতে সহায়তা করেন প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য হাজী মোশারফ হোসাইন। এই হোটেলের অদূরে অবস্থিত বান্দরবান জেলা সদরের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। অনেকেই সকালের সুস্বাদু নাস্তা সেরে ছুটে যায় সেখানে। জেলা প্রশাসন তিলে তিলে গড়ে তুলেছে এটি। পাহাড়ি লেকে নৌকা ভ্রমণ, দুটি ঝুলন্ত সেতু দিয়ে লেক পারাপার, ক্যাবল কার, ওয়াচ টাওয়ার, রেস্ট হাউস, সুদৃশ্য বেঞ্চ ও ছাতা, ওয়াক ওয়ে, অনেক সিঁড়ি, পরিচয় সম্বলিত সাইনবোর্ড সাঁটানো বৃক্ষ সহ আরো কতো কী না আছে এই পর্যটন কেন্দ্রে।
জেলা প্রশাসন 'মেঘলা' ছাড়াও আরো ক'টি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে জেলা সদরে। তন্মধ্যে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ ফুট উচ্চতার পাহাড়ে গড়ে তোলা ‘নীলাচল’। যেখানে গেলে মেঘ ও পাহাড়ের মিতালি এবং বান্দরবান জেলা শহরসহ চারপাশের দৃশ্যাবলি মন ভরে অবলোকনের বহুরূপী স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। সেসব স্থাপনায় গিয়ে পর্যটক বা ভ্রমণকারীরা ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। চাঁদপুর প্রেসক্লাবের আনন্দ ভ্রমণে অংশগ্রহণকারীরা ‘নীলাচলে’র নীলে গিয়ে বুঁদ হতে মোটেও ভুল করেনি।
নাইট হেভেনের ডাইনিংয়ে শুক্রবার সকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার খেয়ে সকলে সুখনিদ্রা যাপনের পর শনিবার ভোরে ঘুম থেকে উঠে বান্দরবান জেলার সবচে' আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট 'নীলগিরি' যেতে। সাতটি 'চাঁন্দের গাড়ি' নামের খোলা জীপ চলে আসে হোটেল প্রাঙ্গণে। এসব গাড়ি সোয়া ৭ টায় রওনা দিয়ে ৯টার মধ্যে পৌঁছে যায় ২২০০ ফুট উচ্চতার পাহাড়ে অবস্থিত নীলগিরি হিল রিসোর্টে। সেনাবাহিনী পরিচালিত এই রিসোর্টের কেন্টিনে বিননি ধানের চালে তৈরি তরল (লেটকা) খিচুড়ি খেয়ে সবাই আকাশের সুনীলে মেঘঢাকা পাহাড়, সবুজ বনবনানি, নান্দনিকতায় নির্মিত সব স্থাপনা, হেলিপ্যাড সহ অন্যান্য কিছু দেখে ও অসংখ্য ছবি তুলে বেলা সাড়ে ১০টার মধ্যে অতৃপ্তি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে হোটেলে ফেরার উদ্দেশ্যে। সাড়ে ১২ টার আগেপরে পৌঁছে যায় সবাই। সবার মুখে একই কথা, নীলগিরি না দেখলে মনে হয় নিজদেশের আত্যন্তিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটা কিছু দেখাই বাকি থেকে যেতো।
নাইট হেভেনে মধ্যাহ্ন ভোজশেষে বিকেল ৩টার মধ্যে কক্সবাজার অভিমুখে রওনা দেয় তিনটি বাস। মাগরিবের আজানের কিছু পর বাস তিনটি পৌঁছে যায় মেরিন ড্রাইভ সড়কের সানসেট বে হোটেলে। সাগরতীরের এ হোটেলটি চাঁদপুরের সুসন্তান ইউনুছ উল্লাহর মালিকানাধীন, এক সময় সাংবাদিকতায় যার ছিলো সংশ্লিষ্টতা। এ হোটেলের রুম থেকে, বারান্দা ও ছাদ থেকে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মুহূর্মুহু গর্জন দেখা ও উপভোগ করা যায় অনায়াসে। লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্টের বাজারে-পরিবেশ এড়িয়ে নীরবে একান্ত আপন করে সমুদ্র সৈকতে অবগাহনের সার্বক্ষণিক পরিবেশ রয়েছে এখানে। সানসেট বে হোটেল থেকে পাথর নিক্ষেপ দূরত্বে কোলাহলহীন এই সৈকত কবিমনকে করে উতলা, ভাবুককে করে উদাসীন। হোটেল পরিচালনায় রুচিবোধের সাবলীল পরিচয় তুলে ধরে হোটেলটিকে মানসম্পন্ন সার্ভিস, সুইমিংপুল, স্পা, লিফট, ডাইনিং স্পেস কাম হলরুমের মাধ্যমে অতিথি /পর্যটকবান্ধব করা হয়েছে। খাবারের মান স্বাস্থ্যসম্মত ও মুখরোচক। এ হোটেল ও পার্শ্ববর্তী আরেকটি হোটেলে দুরাত অবস্থান করে স্বেচ্ছাধীন অবস্থায় মহেশখালী সহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ঘোরাঘুরি করে, কেনাকাটা করে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের আনন্দ ভ্রমণে অংশগ্রহণকারীরা সোমবার সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথিমধ্যে চট্টগ্রাম শহরে রেল স্টেশনের সম্মুখস্থ রিয়াজুদ্দিন বাজার এলাকার ইয়াম্মি ফুডস্ রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবারের বিরতি দেয়া হয়। খাবার গ্রহণকালে চাঁদপুর শহরের বাবুরহাট হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ হাই শেখের পুত্র, কোতোয়ালি থানার ওসি পরাগের উপস্থিতি ছিলো নৈকট্য উপভোগের মাহেন্দ্রক্ষণ।
প্রায় ১১ ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে রাত ৯টার আগে-পরে তিনটি বাস পৌঁছে যায় হাসান আলী হাই স্কুল মাঠে। সবাই আনন্দ রেশ নিয়ে ফিরে যায় যার যার ঘরে।
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের এই আনন্দ ভ্রমণটি কতোটা তৃপ্তিদায়ক ছিলো, সেটি রোববার রাতে সানসেট বে হোটেলের হলরুমে আয়োজিত র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠানে প্রতিজন বক্তার বক্তব্যে স্বতঃস্ফূর্ততায় অভিব্যক্ত হয়েছে। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আল ইমরান শোভনের অসুস্থতাজনিত অনুপস্থতিতে সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুর রহমান সুমনের সক্রিয়তায় সাবেক সভাপতি শহীদ পাটোয়ারী, বিএম হান্নান, গিয়াসউদ্দিন মিলন ও সাবেক সম্পাদক জিএম শাহীন সহ অভিজ্ঞ অন্য ক'জন সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতা যে প্রেসক্লাবের এ আনন্দ ভ্রমণটিকে সাময়িক অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জিং অবস্থা থেকে বাস্তবতার আলোকে উদ্ভাসিত করেছে এবং সর্বাত্মক প্রাণবন্ত ও সফল করেছে, বিশেষ করে মনে রাখার মতো পর্যায়ে নিয়ে গেছে, সেটা স্বীকার করতে সভাপতি এএইচএম আহসান উল্লাহর কার্পণ্য নয়, বরং বাঞ্ছনীয় উদারতা তাঁর কথাবার্তায় ফুটে উঠেছে।