প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ফরিদগঞ্জের মাটিখেকোরা যেন দুর্দমনীয়---
‘বিদ্যালয়ের নামে জমি লিজ নিয়ে মাটি বিক্রি করে অর্থ লোপাট ॥ বাঁধ তৈরি করায় জলাবদ্ধতায় হুমকির মুখে চাষাবাদ' শিরোনামে গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠের শেষ পৃষ্ঠায় একটি সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদটিতে লিখা হয়েছে, বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজে ব্যবহারের জন্যে খাস জমি লিজ নেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু লিজকৃত জমি থেকে অবৈধভাবে ভেক্যু দিয়ে মাটি উত্তোলন করে বিক্রিত অর্থের কিয়দংশ বিদ্যালয়ের ফান্ডে দিয়ে বাকি অর্থ ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে। মাটি কাটার কারণে ওই এলাকায় অর্ধশত পরিবারের চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতার। হুমকির মুখে পড়েছে কয়েক একর ফসলি জমির আবাদ। ঘটনাটি ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নের। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আষ্টা মহামায়া সংলগ্ন গুচ্ছগ্রাম এলাকার ১ একর ৭১ শতক খাস জমি বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজে ব্যবহারের জন্যে লীজ নেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গত দেড় বছর পূর্বে হঠাৎ করে ফসলি জমি থেকে ভেক্যু দিয়ে মাটি উত্তোলন করে বিক্রি শুরু হয়। স্থানীয়রা জানান, উত্তোলনকৃত মাটি বিক্রি করে টাকা ওই সময়ের বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির বৃহদাংশ নিজেরাই হাতিয়ে নেয়। স্থানীয়রা তাতে বাধা দিলে প্রভাবশালী একটি চক্র ক্ষমতার দাপট ও মামলার ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখে। অন্যদিকে ফসলি জমিকে জলাভূমিতে পরিণত করে স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীর ডাক্তার ও মোস্তফা পাটওয়ারী গংয়ের কাছে সরকারি নিয়মনীতির উপেক্ষা করে মাছের খামারের জন্যে ভাড়া দেয়। কিন্তু মাছের খামারের বাঁধের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ওই এলাকায় কয়েক একর জমিতে চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা কৃষক আমিনুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম বেপারীসহ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, মাছের খামারের কারণে তাদের কয়েক একর আবাদি জমি স্থায়ী জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। মাটি বিক্রির সময় আমরা বাধা দিলে বিদ্যালয়ের কমিটি ও তখনকার ক্ষমতাসীন নেতারা আমাদেরকে মামলার হুমকি দেয়। এবারের বৃষ্টিতে এসব জমিতে গলাসমান পানি ছিলো। সরকারি কালভার্ট থাকলেও খামারিদের প্রতিবন্ধকতার কারণে পানি নিষ্কাশন হয়নি। এছাড়া গুচ্ছগ্রামের অধিবাসীসহ অর্ধ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে।
আষ্টা মহামায়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হোসেন বলেন, বিদ্যালয়ের লিজকৃত জমি থেকে তখনকার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আব্দুস সাত্তার পাটওয়ারী প্রশাসনকে ম্যানেজ করে মাটি বিক্রি করেছেন, আমি নিরূপায় ছিলাম। এ বিষয়ে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি আব্দুস সাত্তার পাটওয়ারী বলেন, লিজকৃত জমি থেকে মাটি কাটার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান পাটওয়ারী বলেন, বিদ্যালয়ের লিজকৃত জমি থেকে কয়েক লাখ টাকার মাটি বিক্রির বিষয়টি আমি নিশ্চিত হয়েছি। তখনকার আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এমনটা করেছেন। ফসলি জমিকে মাছের খামারে পরিণত করার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌলি মন্ডল বলেন, খাস জমি থেকে মাটি বিক্রির বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ-খবর নিয়ে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ইউএনও যা বলেছেন, তা গতানুগতিকই বলেছেন, যেমনটি বলে থাকেন অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তাই। কারণ, তারা ফলোআপের বিষয়ে খুব কমই প্রশ্নের মুখোমুখি হন। আমাদের মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বা গভর্নিং বডিতে ঢুকে এক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী লোক ব্যক্তিস্বার্থে কী করে তার জ্বলন্ত উদাহরণ উপরোল্লিখিত সংবাদটি। এ সংবাদটিতে ফরিদগঞ্জের মাটিখেকোরা যে কতোটা শক্তিধর, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে যে কীভাবে সরকারি জমিকে জলাশয়ে পরিণত করতে পারে তার বিবরণও জানা গেলো। চাঁদপুর, হাইমচর ও মতলবে বালুখেকোরা দুর্দমনীয়, সেটা কে না জানে। কেননা এই বালু নিয়ে অতীতে কী তুলকালাম কাণ্ডই না হয়ে গেলো। এখন কিছুটা কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয় নি। ফরিদগঞ্জে অনেক ব্রিকফিল্ড থাকায় এবং জমিতে ফসল চাষাবাদের চেয়ে মাছচাষ লাভজনক হওয়ায় কিছু লোক মাছের ঘের তৈরির জন্যে বেড়িবাঁধ বানানো ও সেটি সংরক্ষণের ধান্ধায় থাকে বলে মাটির চাহিদা সবসময়ই থাকে। এজন্যে এখানে মাটি ব্যবসা লাভজনক এবং সে কারণে মাটি ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হতে প্রশাসন ও শাসক দলসহ অন্য বড়ো দলের নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। এতে তারা দুর্দমনীয় হয়ে মাটিখেকোর কুখ্যাতি পেয়ে যায়। রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের কথা যারা ভাবছেন, তাদেরকে এই বালুখেকো ও মাটিখেকোদের দমনে শুধু ফরিদগঞ্জে নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ। খেয়াল রাখতে হবে সবসময়, সর্ষের ভেতরে ভূত থাকে। এই ভূত তাড়ানো অনেক কষ্টকর।