রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১৬

স্বপ্নিল সফর

সুনির্মল দেউরী
স্বপ্নিল সফর

(গতকালকের পর)

সপ্তমী পূজার বিরতিতে প্রদীপের সাথে নৌকায় চড়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে স্বপ্নিল। মনোহরপুর মূলত একটি বিল এলাকা। প্রতিটি বাড়ির চতুর্দিকে নিচু ভূমি থেকে মাটি তুলে পর্যায়ক্রমে একটি কান্দি ও একটি জলাশয় তৈরি করা হয়েছে। কান্দিতে রয়েছে হরেক রকমের শাক-সবজির সমারোহ যেমন-ঢেঁড়স, পটল, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি। কান্দির দুপাশে মাচায় ঝুলছে শশা, মরমা, লাউ, কাকরোল, করোলা, চিচিংগা, ঝিংয়েসহ আরও অনেক কিছু। কচি শসা বা মরমা দেখে কার না খেতে ইচ্ছে করে? এক কৃষকের বদান্যতায় পূরণ হয় এই পরিদর্শকদ্বয়ের সেই আকাঙ্ক্ষাও।

প্রচুর শাকসবজি উৎপাদনের পাশাপাশি দেশীয় মাছের এক সুবৃহৎ উৎস এই বিল। বিলের জলে নৌকায় চড়ে বেড়ানোর সময় সে দেখতে পেলো বিভিন্ন স্থানে মাছ ধরার ফাঁদ, যেমন-চাঁই, জাল, ভুচনি, বরেঙ্গা ইত্যাদি দেশিয় মাছ ধরার ফাঁদ পাতা রয়েছে। সেই ফাঁদে কোনো মাছ পড়েছে কি না তা বুঝতে না পারলেও স্বপ্নিল নিজে যে প্রণয় ফাঁদে পা দিয়েছে তা ঠিকই অনুভব করতে পারে মাচায় ঝুলন্ত কচি ঝিঙ্গে তুলতে থাকা ষোড়শী মেয়েটির চোখে চোখ পড়াতে। তন্বীর ডাগর চোখের ভ্রূর কাঁপন জানিয়ে দেয় অপরিচিতের অপলক দৃষ্টি অস্বস্তিকর ভাললাগা।

‘এ কি গাঁয়ের মেয়ে না কি জলপরী’! রোমান্টিক চিন্তায় মগ্ন হয়ে স্বপ্নিল স্বপ্ন বুনতে শুরু করে নীল আকাশের নিচে বসেই।

কলমি-টগর ফুলও যে মানুষকে বিমোহিত করতে পারে তা এখানে না আসলে স্বপ্নিল কোনো দিনও অনুধাবন করতে পারতো না। তার মনে হতে থাকে মহান সৃষ্টিকর্তা যেন এই গ্রামটিকে গড়েছেন অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমিরূপে। মন হরণকারী সমস্ত উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত এ গ্রামের নান্দনিক দৃশ্য দেখে সে এর নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পায়।

প্রায় দু-তিন ঘণ্টা ঘুরেফিরে তার সঙ্গীকে বিদায় জানিয়ে একটি নির্জন পুকুর থেকে একা একা স্নান করে ঘরে ফিরলো স্বপ্নিল। সকালের তৈরি করা খাবার খেয়ে ভট্টাচার্য মহাশয়কে সহায়তা করার জন্যে আবার মন্দিরে গেলো সে। একটি ছোট্ট নৌকায় চড়ে তাকে একা একাই মন্দিরে যাওয়া আসা করতে হয়। তাই নৌপথের পাশের একটি কান্দিকে ‘রায়’ বাড়িতে ঢোকার চিহ্ন হিসেবে ঠিক করে নেয় স্বপ্নিল।

রাতে নৌ-পথের নির্দিষ্ট চিহ্ন দেখে স্বপ্নিল ‘রায়’ বাড়িতে রান্নার আয়োজন করতে ফিরলে গৃহকর্ত্রী বললেন “বাবা, তুমি ছেলে মানুষ এতো কষ্ট করে রান্না করো, দেখলে মায়া হয়। না হয় আমরাই আলাদা করে রান্না করে দেই?” গৃহিণীর কথা শেষ হতে না হতেই স্বপ্নিলের উত্তর “না, না, সে আমার অভ্যেস আছে, কোনো সমস্যা নেই কাকী মা।”

কাঠ-খড় পুড়িয়ে রান্না করা যে কতেটা কষ্টকর তা এই দুবেলাতেই বুঝে গেছে স্বপ্নিল। মা-বোনেরা যে কতোটা ত্যাগ স্বীকার করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিবারের সবাইকে প্রতিদিন রান্না করে উদরপূর্তি করান তা অনুধাবন করতে পেরে নিজের মায়ের মুখশ্রী ভেসে উঠছে তার হৃদয়পটে। তবে মনের অধীরতা গোপন রেখেই সে তার কাজ করে চললো। আজ স্বপ্নিলের রান্না করা খাবার খেলেন ভট্টাচার্য মহাশয়।

নিজের হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে শুতে যায় স্বপ্নিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করে ঐ অপরিচিতার মায়াবী চোখের গোপন রহস্য। স্বপ্নিলের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায় তার নিশিযাপনের এই স্বগতোক্তিতে--

আজিকে রজনী কাটিছে কেমনি

বুঝিবার নাহি কেহ আছে,

বিনিদ্র রজনী এপাশ ওপাশ করি

ক্ষণে ক্ষণে সে-ই ফিরে আসে।

কাড়ি নিল নিদ্রা-ঘুম

হরিলো যে মন,

সঙ্গ যে চায় তনু

নিবিড় আলিঙ্গন।

আজ মহা অষ্টমী। স্বপ্নিলদের বাড়িতে তার দিদি, দুলাভাই ও ভাগ্নি এসেছে। মোবাইলে এ খবর পাওয়ার পরে এখানে এক মুহূর্তও অবস্থান করতে ইচ্ছে নেই তার। ভট্টাচার্য মহাশয়কে এ কথা পাড়তেই তিনি একেবারে কাতর কণ্ঠে স্বপ্নিলকে বললেন,“বাবা, তুমি না থাকলে আমি একা এ কাজ সমাধা করে যেতে পারবো না, একটু কষ্ট করে হলেও আর দুটা দিন আমার সাথে থাকো।”

বন্ধুপিতার এই করুণ অনুরোধ অবজ্ঞা করার মত ধৃষ্টতা স্বপ্নিল কিছুতেই দেখাতে পারলো না। তবে এলাকাটা ভাল করে দেখার জন্যে একটু সুযোগ চেয়ে নেয় সে। ফলে এ দিনও বিরতিতে প্রদীপকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে স্বপ্নিল। মনোহরপুরের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে একটি বাড়িতে উপস্থিত হয় তারা।

সেখানে একজন লোকের সাথে নরেনরূপী স্বপ্নিলের পরিচয় ঘটে, যার নাম শ্রী রমেন শিকদার। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি বলেন যে, নিমতলী গ্রামে তাঁর শ্বশুর বাড়ি এবং শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ মণ্ডল তাঁর শ্বশুর মহাশয়। কথাটা শুনে স্বপ্নিল একটু চমকিত হলেও কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, শুনেছিলাম ধীরেন বাবুব এক মেয়েকে মনোহরপুরের দিকে বিয়ে দিয়েছেন। তবে ঠিক কোথায় তা জানা ছিলো না। ওনার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দু গ্রাম পরে কিনা। তবে আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে ভাল লাগছে, দূরদেশে অন্তত একজন আত্মীয়ের দেখা পেলাম।” তখন রমেন বাবু তাঁর ঘরে তাদেরকে আতিথেয়তা গ্রহণের অনুরোধ করলেন। কিন্তু ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থার স্বপ্নিল তাঁর প্রস্তাব বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করে তাড়াতাড়ি অন্য বাড়ির দিকে রওনা করলে প্রদীপ তার পিছু নেয়।

আসলে, শ্রী ধীরেন বাবু স্বপ্নিলের প্রতিবেশী এবং দূরসম্পর্কের কাকা। কাকাতো বোনের বিয়েতে সে উপস্থিত থাকতে পারে নি। আবার ঢাকায় অবস্থানের কারণে নতুন আত্মীয়দের কারো সাথেই তার পরিচয় ঘটে নি। আর যার ফলেই এ যাত্রায় তার শেষরক্ষা হলো। তবে যে আশায় আজ স্বপ্নিল বিভিন্ন বাড়িতে ঢুঁ মেরেছে তা নিরাশাই হয়ে রইলো। কোথাও দেখা মিললো না তার তন্দ্রাহরণীর।

সন্ধ্যায় রাতের খাবার তৈরির জন্যে ঘরে ফেরার সময় স্বপ্নিল দেখলো উঠোনে একটি বালতিতে অনেক তাজা সরপুঁটি মাছ। এগুলো দেখেই তার জিভে জল ধরেছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ যে অন্যদের রান্না গ্রহণ করে না তা মনে হতেই তার মুখ হয়ে গেলো বাংলার পাঁচ।

ঘুরতে-বেড়াতে এসে একটু ভাল-মন্দ আরাম-আয়েশে খাবে তা আর হলো কোথায়-- খেতে হয় নিজেকে কষ্ট করে! বড়ো বড়ো পুঁটিগুলোর কথা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না ত্যক্ত-বিরক্ত স্বপ্নিল। রান্নার আয়োজন করছে এমন সময় গৃহকর্ত্রীর ডাক পেয়ে ফিরে তাকায় সে। গৃহকর্ত্রী বললেন,“বাবা নরেন, তোমার কাকা বিল থেকে কিছু পুঁটি মাছ ধরে এনেছেন। আমি রান্না করি, তোমরা খাবার সময় মাছ নিয়ে খেয়ো।”

সাথে সাথে স্বপ্নিল বললো, “সে কী কথা কাকী মা! আপনি ব্রাহ্মণদের নিয়ম জানেন না বুঝি?”

কথাটা শুনে গৃহকর্ত্রী একটু দমে গেলেও ঝোপ বুঝে কোপ মারায় ওস্তাদ স্বপ্নিল তৎক্ষণাৎ মুচকি হেসে বললো, “কাকী মা, আমরা রান্না করলে আপনাদের খেতে তো কোনো অসুবিধা নেই? মাছগুলো কেটে দিন আমরাই রান্না করি।” ভাগ্য সুপ্রসন্ন! স্বপ্নিলের প্রস্তাবে সায় দিলেন স্নেহময়ী গৃহকর্ত্রী। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়