প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:৫৭
কোটা পূরণে ব্যর্থ বাংলাদেশ : দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজার বিশ্লেষণ

দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম বৃহৎ শক্তি, অভিবাসী শ্রমিকদের জন্যে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। দেশটির উন্নত কর্মপরিবেশ, উচ্চ বেতন এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধা অনেক দেশের কর্মীদের জন্যে স্বপ্নের মতো। ‘এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম’ (ইপিএস)-এর মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশের কর্মীদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। ২০০৮ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া চালু থাকলেও বাংলাদেশ এই সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোটা বরাদ্দ পাওয়ার পরও কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে যে বিশাল ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, তা দেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতের জন্যে একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।
কোটা পূরণে ব্যর্থতা ও তার কারণ : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী কোটা বরাদ্দ দিয়েছে। যেমন, ২০২৪ সালে ১১ হাজার ৫০০ জনের কোটা থাকলেও মাত্র কয়েক হাজার কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভাষাগত দক্ষতা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাব।
ভাষাগত দুর্বলতা : দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজারে প্রবেশের জন্য কোরীয় ভাষা পরীক্ষায় (কড়ৎবধহ খধহমঁধমব ঞবংঃ) উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। নিয়োগকর্তারা এমন কর্মী পছন্দ করেন, যারা স্থানীয় ভাষায় যোগাযোগ করতে পারেন, যা কাজের দক্ষতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদনে দেখা যায়, নেপাল, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর কর্মীদের ভাষাগত দক্ষতা তুলনামূলকভাবে বেশি, যার কারণে নিয়োগকর্তাদের পছন্দের তালিকায় তারা এগিয়ে থাকে। বাংলাদেশের কর্মীদের ভাষাগত দুর্বলতা এই ক্ষেত্রে একটি বড়ো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাব : ভাষা পরীক্ষার পর একটি দক্ষতা পরীক্ষা (ঝশরষষ ঞবংঃ) হয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি কর্মীদের সেই মানের প্রশিক্ষণ থাকে না, যা তাদের কোরিয়ান কোম্পানিগুলোর চাহিদা পূরণে ব্যর্থ করে তোলে। বোয়েসেলের তথ্য অনুযায়ী, ভাষা ও দক্ষতা পরীক্ষায় পাস করার পরও পুরো প্রক্রিয়াটি কোরিয়ান কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে। কোম্পানিগুলো কর্মীর প্রোফাইল দেখে কর্মী নির্বাচন করে। ফলে, শুধুমাত্র ভাষা পরীক্ষায় পাস করা যথেষ্ট নয়; নিয়োগকর্তার চাহিদা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কারিগরি দক্ষতা থাকাও আবশ্যক।
প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা : কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর কর্মী নির্বাচনের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। এর ফলে অনেক প্রার্থীর ভিসার আবেদন প্রক্রিয়াকরণে দেরি হয়। দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করার কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী হতাশ হয়ে অন্য বিকল্পের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
অন্যান্য দেশের সাফল্যের কারণ : দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজারে নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান তাদের কোটা প্রায় পুরোপুরি পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো, তাদের সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকরী পদক্ষেপ এবং কর্মীদের প্রস্তুতি। তারা কর্মীদের ভাষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার দেয় এবং নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও দ্রুত করার জন্যে কোরিয়ান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে। এই দেশগুলো তাদের কর্মীদের ভাষা এবং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ জোর দেয়, যা তাদের শ্রমবাজারে আকর্ষণীয় করে তোলে।
বাংলাদেশের সামনে করণীয় : দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একটি সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে :
১. ভাষাগত ও কারিগরি প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ : সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী উন্নত মানের কোরীয় ভাষা শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে শুধু ইপিএস পরীক্ষাই নয়, সরাসরি নিয়োগকর্তার চাহিদা পূরণের জন্যেও কর্মীরা প্রস্তুত হতে পারবেন।
২. প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও গতিশীলতা বৃদ্ধি : বোয়েসেল এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও দ্রুত করতে হবে। কর্মীদের ভিসা ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্যে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করা উচিত।
৩. বাজার গবেষণা ও চাহিদা অনুযায়ী কর্মী তৈরি : দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজারের চাহিদা সম্পর্কে নিয়মিত গবেষণা করে সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট পেশায় কর্মী তৈরি করতে হবে। যেমন, যদি নির্মাণ বা কৃষি খাতে বেশি চাহিদা থাকে, তবে সেই খাতের জন্যে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি করা যেতে পারে।
৪. কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার : কোটা বৃদ্ধি এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও সুগম করার জন্যে কোরিয়ান সরকারের সাথে কূটনৈতিক আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের জন্যে উচ্চ রেমিট্যান্স উপার্জনের একটি বড়ো সুযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্যে শুধুমাত্র কোটা বরাদ্দের অপেক্ষা না করে, আমাদের নিজেদের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা দূর করার ওপর জোর দেওয়া উচিত। এতে করে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাত শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই নয়, বিশ্বজুড়ে আরও শক্তিশালী অবস্থানে পেঁৗছাতে পারবে।
লেখক : সাংবাদিক, এক্স ভাইস-চেয়ারম্যান (কোরিয়া বাংলা-প্রেসক্লাব)
+৮২০১০৮৩৭২৭৯০৬