প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৩৪
বীর মুক্তিযোদ্ধা হানিফ পাটোয়ারীর মৃত্যুতে শোক

চঁাদপুর জেলায় কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যঁারা বহুল পরিচিত তঁাদের যুদ্ধকালীন অসম সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্যে। এঁদের অন্যতম মুক্তযুদ্ধকালীন ফরিদগঞ্জ থানার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) কমান্ডার হানিফ পাটোয়ারী। তিনি আর বেঁচে নেই। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) রাত আড়াইটায় রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। তিনি বার্ধক্যজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে গত ক’বছর যাবত চঁাদপুর শহরের কোড়ালিয়ায় নিজ বাসভবনে সার্বক্ষণিক নার্সের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মাঝেমধ্যে তঁার অসুস্থতা বাড়লে স্থানীয় প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হতো এবং অবস্থার উন্নতি হলে তঁাকে আবার বাসায় নিয়ে যাওয়া হতো। ১০ আগস্ট ২০২৫ তারিখে তঁার খাদ্যগ্রহণ বন্ধ হয়ে গেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাসায় এনে তঁাকে চিকিৎসার ব্যবস্থাগ্রহণ করালেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয় নি। এমতাবস্থায় ১৬ আগস্ট চঁাদপুর শহরের ষোলঘরস্থ ফেমাস স্পেশালাইজড হাসপাতালে তঁাকে ভর্তি করা হয় এবং আইসিউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ১৮ আগস্ট রাত ১টায় ঢাকা থেকে আনীত আইসিইউ সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্সযোগে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় এবং সেখানে আইসিইউতে রেখেই তঁার চিকিৎসা চলে। খবর পেয়ে আমেরিকা থেকে ছুটে আসেন তঁার স্ত্রী দিলরুবা চৌধুরী ও তঁার কন্যা রুনা। তঁারা ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও হানিফ পাটোয়ারীর চিকিৎসা অব্যাহত রাখেন। এর মধ্যেই তিনি মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটায় (বুধবার) সকল প্রচেষ্টা ও মায়ার বঁাধন ছিন্ন করে পরকালে পাড়ি জমান। মৃত্যুকালে তঁার বয়স হয়েছিলো ৮১ বছর। তিনি স্ত্রী ও কন্যাসহ বহু আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বুধবার জোহর নামাজের পর নিজ বাড়ির সম্মুখস্থ মসজিদ প্রাঙ্গণে তঁার নামাজে জানাজাশেষে পারিবারিক কবরস্থানে তঁাকে দাফন করা হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হানিফ পাটোয়ারী ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তঁার বাবা ছিলেন হাজী আমজাদ আলী পাটোয়ারী ও মাতা আজিজা বেগম। ছয় ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। চঁাদপুর শহরের বিখ্যাত গণি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন তিনি। স্কুল জীবন থেকে তিনি অ্যাথলেটিক্স, বাস্কেটবল, সঁাতারসহ বিভিন্ন ক্রীড়ায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করে তিনি চঁাদপুর কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে ভীষণ সক্রিয় হন এবং ১৯৬৯ -১৯৭০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিএস নির্বাচিত হন। তঁার সাথে তঁার নিজ এলাকার অগ্রজপ্রতিম আব্দুর রহমান হয়েছিলেন ভিপি। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সহ স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি অংশ নেন এবং ১৯৭১ সালে তিনি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝঁাপিয়ে পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ব্যবসা করেন। তারপর সপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমান। সেখানে কয়েক বছর থেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে স্ত্রী-কন্যাকে রেখে দেশে চলে আসেন এবং কোড়ালিয়ায় পৈত্রিক বাড়িতে দোতলা বাসভবন বানিয়ে একাকী বসবাস করছিলেন এবং এ বাসভবনেই ক্রমশ বার্ধক্যজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হন। এ সময তিনি তঁার মুক্তিযুদ্ধালীন স্মৃতিকথা নিয়ে বই প্রকাশ করেন। তিনি চঁাদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তবে স্থানীয় সাংসদবৃন্দসহ ভুয়া ও দলবাজ কিছু মুক্তিযোদ্ধার অসহযোগিতার কারণে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়েও হেরে যান। এতে তিনি যথেষ্ট মনঃকষ্ট পান।
জনাব হানিফ পাটোয়ারী তো আশি বছরের বেশি বয়স পেয়েছেন। কিন্তু অনেক মুক্তিযোদ্ধা তঁার মতো এতোটা বয়স না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। সে কারণে যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। হানিফ পাটোয়ারী অনেক মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে যুদ্ধকালীন তঁার অসম সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্যে মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে তঁার নাম। তিনি মুক্তিযুদ্ধ না করে কেউ যাতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হতে পারে, সে ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার, প্রতিবাদী ও নিরাপস। এজন্যে তিনি সুবিধাবাদী অনেক মুক্তিযোদ্ধার বিরাগভাজন হয়েছেন। এ বিষয়টিকে তিনি পাত্তা দিতেন না। তিনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্তির সুপারিশ লোভ লালসা ও শাসক দলীয় চাপের মুখেও করেন নি। সেজন্যে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পুরো সময়ে অনেক সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান থেকে ছিলেন বঞ্চিত। তাতে তঁার কোনো দুঃখবোধ ছিলো না, স্পষ্টবাদিতায় কমতি ছিলো না। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হানিফ পাটোয়ারীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি, তঁার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।