প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৫, ০৯:২০
প্রবাসে ঈদের উৎসব যেনো বিষাদের প্রতিচ্ছবি

পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার আশায় প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি প্রবাসে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সাম্প্রতিক জনশুমারি অনুযায়ী, বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ৫০ লাখের অধিক। এর মধ্যে সৌদি আরবেই রয়েছে প্রায় ২.১২ মিলিয়ন প্রবাসী, যা প্রবাসীদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
‘ঈদ’ শব্দের অর্থ হলো আনন্দ। এই দিনটি বারবার ফিরে আসে বলেই এর এমন নামকরণ। ঈদের দিন নামাজ শেষে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কোলাকুলি, সালামি বিতরণ, সেমাই-পায়েস রান্না আর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে হাসি-আড্ডায় মেতে ওঠাই ঈদের মূল সৌন্দর্য। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকা অধিকাংশ প্রবাসীর জন্যে এসব আয়োজন শুধুই এক অপূর্ণ স্বপ্ন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের চিত্র হচ্ছে-- প্রবাসে ঈদের দিনেও বেশিরভাগ প্রবাসীর ভাগ্যে ছুটি থাকে না! এমনও হয় যে, অনেক প্রবাসী ঈদের নামাজটুকুও আদায় করার সুযোগ পায় না! সে ক্ষেত্রে এমন প্রবাসীকে যদি প্রশ্ন করা হয় ঈদ কেমন কাটলো? এমন অবস্থায় ওই প্রবাসীর উত্তরটা কেমন বিষাদের হবে তা বলার অপেক্ষা থাকে না!
সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ মহসিন মাল জানান, রাজধানী রিয়াদের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে গত রমজানের ঈদের আগের দিন অর্থাৎ চাঁদরাত আমার নাইট ডিউটি ছিলো। যেহেতু ঈদের কয়েকদিন আগেই স্থানীয় নাগরিকদের দীর্ঘ ছুটি শুরু হয়ে যায়, তাই আমাদের মতো প্রবাসীদের ওপর অতিরিক্ত ডিউটির চাপ পড়ে। সারারাত কাজ শেষে ভোরে বাসায় ফিরতেই সুপারভাইজার ম্যাসেজ করে জানালেন, ঈদের দিন সকাল ৭টায় আবারও ডিউটিতে যোগ দিতে হবে। মালিক পক্ষের নির্দেশ, কোনো অজুহাত দেয়ার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়েই আবার প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে ক্লিনিকে ফিরতে হলো।
তিনি আরও বলেন, ঈদের আগের রাতে প্রিয়জনের দেয়া ভালোবাসামাখা পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজে যাবো, তারপর সেমাই রান্না করে রুমমেটদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করবো--এটাই ছিলো মনভরা ছোট্ট একটা পরিকল্পনা। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো নির্মমভাবে ভিন্ন। ঈদের আগের রাত এবং ঈদের দিনের ক্লান্তিকর ডিউটির পর নিস্তেজ শরীরে বাসায় ফিরে সেই প্রতীক্ষিত ঈদের আনন্দের সামান্য ছোঁয়াটুকু অনুভব করতে পারিনি।
প্রবাসী শাহজালাল বলেন, অনেক প্রবাসী রয়েছেন, যারা ঈদের দিনেও জীবিকার তাগিদে ছুটে বেড়ান। তাদের কাছে ঈদের আনন্দের চেয়ে একটি চাকরির সুযোগই যেনো বড়ো সুখের বিষয়। যেমন আমার রুমমেট হাসিব ভাই গত সাত বছর ধরে সৌদি আরবে কর্মরত। আজও দেশে ফিরতে পারেননি। পারিবারিক দায়-দেনা, অভাব-অনটন তাকে আটকে রেখেছে প্রবাসের মাটিতে। অথচ প্রতি ঈদেই তিনি পরিবারকে লাখ টাকা পাঠান, নিজে পরেন পুরানো জামা, ঈদের আনন্দ বিলিয়ে দেন আপনজনদের মাঝে নিজে না থেকেও।’
তিনি আরো জানান, প্রবাসে আমার দেখা অনেক ভাই-বন্ধু আছেন, যারা ঈদের দিন ছুটি পান। শুধু ঈদের দিনই নয়, বরং ঈদের পরবর্তী ৪-৫ দিন পর্যন্ত ছুটি কাটান। ঈদের নামাজ আদায় শেষে তারা দলবদ্ধভাবে ঘুরতে বের হন, খানাপিনা করেন, আড্ডা, আনন্দ আর মোজ-মাস্তিতে মেতে উঠেন। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, যেন ঈদের সব রঙ, সব আনন্দ তারা হৃদয় ভরে উপভোগ করছেন। কিন্তু একান্ত নির্জনে যদি তাদের জিজ্ঞেস করা হয়, ভাই, ঈদ কেমন কাটলো? তাদের চোখে তখন এক অজানা বিষাদের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠে। এতো আয়োজন, এতো আনন্দের মাঝেও যেনো পরিবার-পরিজনের অপূর্ণতা থেকে যায়। ঈদের পরিপূর্ণতা তখন আর হৃদয় ছুঁয়ে যায় না।
প্রবাসীদের ঈদ মানে উট কুরবানি নয়, দামী খাবার নয়—বরং একটি ভালো চাকরির নিশ্চয়তা, মাস শেষে পরিবারের জন্যে টাকা পাঠানোর সক্ষমতা, এবং পরিবার সুস্থ আছে, এসব খবর নিশ্চিত হলেই তাদের কাছে ঈদের আনন্দ লাগে।
অনেক প্রবাসী আছেন, যারা রমজান মাসে মসজিদের ইফতার নেয়ার জন্যে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন, শুধু কিছু রিয়াল বাঁচানোর আশায়। সেই সঞ্চয় যদি দেশে পরিবারের কাজে লাগে, তাতেই তারা তৃপ্ত। প্রবাসীদের ঈদ মানে বিলাসিতা নয়, বরং দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগ। তাদের কাছে ঈদের আনন্দ মানে পরিবারকে সবসময় হাসিমুখে দেখা, সন্তানদের স্কুলে যাওয়া, মা-বাবার সাথে ফোনকলে কথা বলা, স্ত্রীর মুখটা সবসময় হাসিখুশিতে থাকা।