রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৫, ০৮:৪১

ভারত-পাকিস্তান অশনি সংকেত : বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও করণীয়

রহমান মৃধা
ভারত-পাকিস্তান অশনি সংকেত : বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও করণীয়

সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একের পর এক উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছেÑভারত-পাকিস্তানের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ-সদৃশ উত্তেজনা, ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বিস্ফোরণ, বেলুচিস্তানে স্বাধীনতা ঘোষণার সম্ভাবনা, এবং এর মধ্যেই বাংলাদেশকে করিডোর প্রদানের জন্যে বৈশ্বিক চাপ। এই সমীকরণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যেমন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপরও আন্তর্জাতিক চাপ ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্ব বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্যে একদিকে যেমন নতুন সম্ভাবনার জানালা উন্মুক্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি উঁকি দিচ্ছে গভীর সংকট।

ভারত বহুদিন ধরেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ বাড়াতে করিডোরের জন্যে বাংলাদেশে চাপ দিয়ে আসছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই এই করিডোর নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে। সম্প্রতি, একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের ওপর করিডোর প্রদানের জন্যে অর্থনৈতিক সুবিধার প্রলোভন এবং কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকায় এবং আগামী নির্বাচনের পথ তৈরি করতে ব্যস্ত থাকায়, এই সময়টিকে অনেকে ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে দেখছে। তবে এটি জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে একটি গুরুতর ইস্যু এবং এর কূটনৈতিক সমাধান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। সরকার পতনের পর থেকেই দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। একদিকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নানামুখী চাপ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের দাবি, এবং জামায়াত-হেফাজতের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন – সবমিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। সাম্প্রতিক এক ঘটনায়, সাবেক রাষ্ট্রপতি আ. হামিদ সাহেব দেশত্যাগ করেছেন এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী আইভীকে দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্ক দৃষ্টিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এছাড়াও, ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে করিডোর ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা জোরদার করছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান রক্ষা করা এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এখন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ডাক উঠছে, তখনই নতুন এক ধরনের ‘কৌশলগত গণতন্ত্র’ দৃশ্যমান হচ্ছেÑযার শিকড় পরিবারতন্ত্রে। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর উত্থান যেমন একটি রাজনৈতিক আবহ তৈরি করছে, ঠিক তেমনি বিএনপির মধ্য থেকে ভেসে আসছে এক প্রকার ‘দায়িত্বশীল হস্তান্তর’-এর কণ্ঠস্বর। তবে আশঙ্কার জায়গা হচ্ছেÑএই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে যে বিকল্প কাঠামোর আভাস মিলছে, তা আবারও একই ঘূর্ণিতে ফিরে যেতে পারে : পরিবারের হাতে রাষ্ট্রের লাগাম।

ধরা যাক এক কল্পিত প্রশাসনের চিত্র :

প্রধানমন্ত্রী হবেন লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান, যিনি ভার্চুয়াল মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার নব্য দক্ষতায় অভ্যস্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রী হবেন তাঁর সহধর্মিণীÑযিনি পরিবার দেখেছেন, এবার জাতি দেখবেন! পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী হবেন তাঁদের কন্যাÑপরিবারের উত্তরাধিকারেই যেন অভিজ্ঞতার সংজ্ঞা নির্ধারিত হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে দেখা যাবে প্রয়াত কোকোর স্ত্রীকে, আর প্রোটোকলের রূপকার রাষ্ট্রপতির আসনে বেগম খালেদা জিয়া।

এই চিত্র যেমন ব্যঙ্গাত্মক, তেমনি রাজনৈতিক বাস্তবতার ছায়াও বহন করে। প্রশ্ন উঠেÑআমরা কি সত্যিই একটি নব্য গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় যাচ্ছি, নাকি পরিচিত এক বৃত্তের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছি? যখন ‘গণতন্ত্র’ একটি পারিবারিক উদ্যোগে পরিণত হয়, তখন জনগণের অংশগ্রহণ শুধুই একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন চেষ্টা করছে নির্বাচনের রোডম্যাপ নির্ধারণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক আস্থা পুনঃস্থাপন করতে। তবে, ড. ইউনূসের সামনে রয়েছে তিনটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ : (১) জাতীয় নিরাপত্তা ও করিডোর ইস্যুতে ভারসাম্য রক্ষা, (২) রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন, এবং (৩) আন্তর্জাতিক চাপ সামলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ সংরক্ষণ।

তাঁর প্রশাসন ইতোমধ্যে কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেÑযেমন দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়ন, এবং কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়া। তবে তার নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তিনি কতটা দক্ষতার সাথে জাতীয় স্বার্থরক্ষা করতে পারেন, বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক গভীর প্রশ্ন সামনে আসেÑএই সংঘাতে আসলেই কেউ কি লাভবান হবে? পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর সংঘর্ষ কেবল সীমান্ত নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। আরেকটি দিক যা অবহেলিত থেকেছে, তা হলো ভারতের অভ্যন্তরীণ দ্বিচারিতা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, এখানে সংখ্যালঘু হিন্দুরা নিপীড়নের শিকার। অথচ বাস্তবতা বলছে, আজ ভারতের ভেতরেই মুসলিম জনগোষ্ঠী দিনকে দিন ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হচ্ছেÑকখনো নাগরিকত্ব আইন, কখনো দাঙ্গা, কখনো রাষ্ট্রীয় মদদে ঘৃণা ও সহিংসতা। এই দ্বিমুখী নীতি শুধু বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অবিচার নয়, বরং এটি ভারতীয় গণতন্ত্রেরও চরম বিপর্যয়। অতএব, এই যুদ্ধের আগুনে যদি কিছু পুড়ে ছাই হয়, তা হবে মানবিকতা, বিশ্বাস এবং উপমহাদেশের সম্ভাবনা।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দায়িত্বশীল কূটনীতি ও জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হবে। একইসাথে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ থাকে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে এই চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে, যাতে করে বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে পারে।

রহমান মৃধা : গবেষক এবং লেখক। সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়