মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০৩

স্বাগত চৌদ্দশ বত্রিশ

অনলাইন ডেস্ক
স্বাগত চৌদ্দশ বত্রিশ

ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় উৎসবের পাশাপাশি প্রতিটি জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য ও কৃষ্টির উৎসব আছে। এগুলো নেহায়েৎ উৎসব নয়, বলা যায়, এগুলো হলো নাড়ির টান, শেকড়ের সম্মিলন। এ উৎসব হতে পারে নববর্ষকে বরণের, হতে পারে নতুন ফসল ঘরে তোলার, হতে পারে হলকর্ষণের কিংবা হতে পারে পিঠেপুলির। পৃথিবীজুড়ে নানা জাতির এ উৎসবগুলোতে লেগে থাকে মৃত্তিকার ঘ্রাণ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে একটা জাতির সবাই এ ধরনের উৎসবে আনন্দে অবগাহন করে শামিল হয়। এ ধরনের উৎসব অসাম্প্রদায়িক ও অরাজনৈতিক। এ উৎসবগুলো আপামর জনতার।

পশ্চিমা বিশ্বের ‘হ্যালোইন’ মূলত প্রাচীন ফসল কাটার উৎসব থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এটা কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নয়। পারস্যদেশ বা ইরানীদের একটা জাতীয় উৎসবের নাম ‘পদ্ম উৎসব’ বা ‘ জশনে নীলুপার’। এটি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষে অনুষ্ঠিত হয়। পার্সিয়ানদের নওরোজ হলো জাতীয় উৎসব যা বর্ষবরণের উৎসব। এটি একুশে মার্চ বা তার একদিন আগে-পরে অনুষ্ঠিত হয়। ‘হামামাতসু কাইট ফেস্টিভ্যাল’ হলো জাপানিদের জাতীয় উৎসব। এটি আসলে আমজনতার ঘুড়ি উৎসব।

বাঙালিদের জাতীয় উৎসবরূপে যে ক’টি উৎসব এখনও সাড়ম্বরে চর্চিত হয়, তার মধ্যে পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ অন্যতম। মধ্যযুগে বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী আখ্যা দিয়ে যেমন দূরে ঠেলার ষড়যন্ত্র ছিলো, তেমনি আজও বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখকে একদল সাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ধর্মীয় উৎসবের তকমা লাগাতে চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু আপামর বাঙালি এ ধরনের কূটকচালে আবদ্ধ না থেকে ঠিকই পয়লা বৈশাখকে আবহমান কাল থেকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে।

আগেকার দিনে বছর শুরু হতো হেমন্তে আর বছর শেষ হতো শরতে। এজন্যে কেউ কাউকে আশীর্বাদ করতে গেলে বলতো, ‘তুমি শত শরৎ বেঁচে থাকো।’। হেমন্তের শেষ মাস অগ্রহায়ণ দিয়েই শুরু হতো বছর। অগ্র মানে প্রথম, হায়ণ মানে মাস। কিন্তু সম্রাট আকবরের আমলে খাজনা আদায়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় সৌর বর্ষ ও চান্দ্রবর্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সম্রাটের নির্দেশে তাঁর সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি হিজরি বর্ষ ও সৌর বর্ষের সমন্বয় করতে অগ্রহায়ণের পরিবর্তে বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করেন এবং পহেলা বৈশাখকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে প্রচলন করেন। পনরশ ছাপ্পান্ন খ্রিস্টাব্দে তথা নয়শ বিরানব্বই হিজরিতে অগ্রহায়ণের পরিবর্তে বৈশাখ দিয়ে নববর্ষের গণনা শুরু হয়। কিন্তু সে যাবৎ যত বছর অতিক্রম করেছিল বঙ্গাব্দ, তা অটুট রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ, এ কথা পরিষ্কার, সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দের প্রচলনকারী নন। তিনি পয়লা বৈশাখ দিয়ে বর্ষবরণের সূচনাকারী। অর্থাৎ তিনি বাংলা পঞ্জিকায় সংস্কার করে প্রথম মাস অগ্রহায়ণকে অষ্টম মাস এবং সপ্তম মাস বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করেন। আগেকার দ্বাদশ মাস কার্তিক হয়ে যায় সপ্তম মাস।

বঙ্গাব্দের প্রবর্তক কে এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত না পেলেও ভাবা হয়, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে গৌড় রাজা শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। পূর্বে পয়লা বৈশাখ কেবল ঋতুভিত্তিক উৎসব ছিলো। নববর্ষ হতো নবান্নে। অর্থাৎ পয়লা অগ্রহায়ণে। উৎসবের জন্যে হাল্কা হিমের এই সময়টাই ছিলো উপযুক্ত। কিন্তু খাজনা আদায়ের রাজকার্য প্রজার উৎসবকে গরমে ঘামিয়ে নাইয়ে দিলো যেন। ধারণা করা হয়, পুরাণ ঢাকায় মাহিফরাস সম্প্রদায় ছিলো যারা প্রকৃতপক্ষে মুসলিম মৎস্যজীবী। তাদের মধ্যে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের চর্চা ছিলো। তবে তা নববর্ষের চর্চা নয়।

ধীরে ধীরে পয়লা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় উৎসবের বিশালতা ছেড়ে সাম্প্রদায়িক উৎসবে তকমামণ্ডিত হয়েছে। চৌদ্দ ও পনের এপ্রিলের দ্বিবিধ উদ্যাপন আমাদের জাতীয় অসাম্প্রদায়িক উৎসবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। একদল যেমন মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন তোলেন, তেমনি অন্যদল ভিন্ন একদিনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক দিবস উদ্যাপন করে তাতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। এ বৈষম্যের অবসান না হলে সত্যিকার অর্থে পহেলা বৈশাখের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সার্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে বেগ পেতে হবে। আমরা চাই, বাঙালি এক হয়ে একইভাবে পয়লা বৈশাখে মেতে উঠুক।

লোকে বলে, যায় দিন ফাগুনো দিন। সত্যিকার অর্থে ফাগুন শেষেই তো পয়লা বৈশাখ। খরতাপে, তাপস নিশ্বাসবায়ে জীর্ণকে উড়িয়ে পয়লা বৈশাখ আসুক প্রতিটি বাঙালির জীবনে নতুন আশার নববাণী নিয়ে। বৈশাক আসুক জীবনের জয়গান গেয়ে। স্বাগত চৌদ্দশ বত্রিশ। নতুন বছর সবার জন্যে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ ও সমৃদ্ধি। সুস্থির হয়ে উঠুক এ বৈশাখে আমাদের জনজীবন। জীবনকে উদ্যাপনের স্বস্তি নিয়ে নতুন বছর জেঁকে বসুক পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পলল জনপদে। বৈশাখ শাশ্বত সুন্দরের বাণী নিয়ে আমাদের জাগিয়ে রাখুক নতুন জীবনের লক্ষে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়