সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৫, ১১:৫১

মেঘনা উপকূলে মোগল ঐতিহ্যের স্মারক বাখরপুর জামে মসজিদ

মো. মিজানুর রহমান
মেঘনা উপকূলে মোগল ঐতিহ্যের  স্মারক বাখরপুর জামে মসজিদ

চাঁদপুর জেলার সাথে নৌ যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের ঐতিহ্য রয়েছে। যার ফলে এই এলাকায় ভারতীয় মুসলমানদের আগমন ঘটে। তারা অস্থায়ীভাবে এই জেলায় অবস্থান করলেও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে যায়। ওইসব স্থাপনার অংশ হিসেবে জেলার বিভিন্ন এলাকায় চুন-সুরকি দিয়ে তাদের তৈরি করা মসজিদ রয়েছে । মোগল আমলের মসজিদ নামে এসব স্থাপনা পরিচিত। তেমনি চাঁদপুর সদর উপজেলার ১২ নং চান্দ্রা ইউনিয়নের মেঘনা তীরবর্তী বাখরপুর গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪শ’ বছরের পুরানো ঐতিহ্যের স্মারক দক্ষিণ বাখরপুর জামে মসজিদ। যেটি গায়েবি মসজিদ নামেও স্থানীয়ভাবে পরিচিত।

সম্প্রতি সরেজমিনে ওই মসজিদ এলাকা ঘুরে, মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও মুসল্লিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এই মসজিদ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য।

জেলা সদর থেকে এই মসজিদের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সদরের দক্ষিণে সদর-হাইমচর সড়ক হয়ে চান্দ্রা বাজার চৌরাস্তা থেকে দক্ষিণে বাখরপুর গ্রাম। মূল সড়ক থেকে গ্রামীণ সড়ক দিয়ে চান্দ্রা ইউনিয়নের বাখরপুর পশ্চিম পাড়ায় মেঘনা নদীর খুবই নিকটে মসজিদটির অবস্থান।

স্থানীয়দের কাছে এই মসজিদের নির্মাণ সালের সঠিক তথ্য সংরক্ষিত নেই এবং পাওয়া যায়নি। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা ও প্রবীণ লোকদের মতে, মোগল আমলেই এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। কারণ এটির নির্মাণ শৈলী দেখে তাই মনে হয়।

মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন মুসল্লি নাজির পাটওয়ারী (৬৫)। তিনি বলেন, মসজিদ কমপ্লেক্সটি ২৮ শতাংশ জমির ওপর। এর মধ্যে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ভবনটি ৬শতাংশ জমির ওপর নির্মিত। এরপর বিগত প্রায় ৩০ বছর পূর্বে মসজিদের মুসল্লি সংকুলান না হওয়ার কারণে মসজিদ সংলগ্ন পূর্ব দিকে ৮ শতাংশের মধ্যে ৫তলা ভিতের ওপর একতলা ভবনের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। পাশে ঈদগাহ ও পুকুর মিলিয়ে রয়েছে ১৪ শতাংশ।

মোগল স্থাপত্য রীতিতে এই মসজিদটি তিন গম্বুজ ও ৩ তারা বিশিষ্ট। আর এই নির্মাণ কাজ হয় শুধুমাত্র চুন-সুরকি দিয়ে। পুরো মসজিদের চারপাশে ২৮টি চুন-সুরকির তৈরি খুুঁটি রয়েছে। এই খুঁটির সাথে দেয়ালের পুরুত্ব সোয়া ৩ ফুট। পাঁচটি দরজা ও মূল মিম্বারের দুই পাশে দুটি মেহরাব। সোয়া ৩ফুট পুরুত্বের জুল বিম দুটি। মসজিদটি যখন নির্মাণ হয়, তখনকার নির্মাণ শৈলী অনেকাংশ এখন আর নেই। শুধুমাত্র তিনটি গম্বুজের ভেতরের অংশে কিছু হাতে তৈরি নকশা রয়েছে বিভিন্ন রঙের।

মুসল্লিরা জানালেন, এই মসজিদের মূল অংশে প্রায় দেড় শতাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। বর্তমানে বর্ধিতাংশসহ প্রতি জুমআয় প্রায় ৩০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

মসজিদের মুসল্লি নাজির পাটওয়ারী বলেন, ছোট বেলায় এই মসজিদটি সংস্কার না করায় মসজিদের ওপরে বিভিন্ন ধরনের গাছ ও আবর্জনা ছিলো। অনেকের কাছেই এটি জিনের কিংবা গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত। যে কারণে একসময় ভয়ে লোকজন মসজিদের নিকট খুব কম আসতো। এই এলাকাটি মেঘনা উপকূলীয় এলাকা। নদী ভাঙ্গনে অনেক পরিবার নিজ বসতি ছেড়ে অন্যস্থানে বসতি গড়েছেন। বিগত প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগ থেকেই মসজিদটি সংস্কারে এলাকার লোকজন এগিয়ে আসে।

মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি হাফেজ আহম্মেদ পাটওয়ারী বলেন, এই মসজিদ নির্মাণের প্রকৃত সাল-তারিখ কেউ বলতে পারে না। তবে আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানতে পারি, মোগল সাম্রাজ্যের আমলে বণিকরা এই দেশে ব্যবসা করতে আসে, তখনই তারা এসব মসজিদ নির্মাণ করে। এই মসজিদের অনেক ঐতিহ্য ও সুনাম রয়েছে। অনেক দূর দূরান্ত থেকে লোকজন মসজিদটি দেখার জন্যে আসে। অনেকে আবার নিয়ত-মানত করে।

মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক মো. ইউসুফ গাজী বলেন, অনেকেই এই মসজিদকে গায়েবি কিংবা জিনের মসজিদ বলেন। আসলে তা নয়। আমাদের পূর্ব পুরুষদের সাথে কথা বলেও নির্মাণ সাল জানা যায়নি। তবে অনেকের ধারণা মতে, এটি মোগল আমলেই তৈরি। তখন তারা মসজিদের উত্তর ও পূর্বে পুকুর খনন করে ওই মাটির ওপর মসজিদ নির্মাণ করে। চুন ও সুরকি ব্যবহারে পুরো মসজিদ নির্মাণ হয়। এতে কোনো ধরনের রড ও সিমেন্ট ব্যবহার হয়নি। তবে গত প্রায় ৩০-৩৫ বছর পূর্বে চুন ও সুরকির দেয়াল থেকে পানি চুয়ে চুয়ে পড়ার কারণে এটি উন্নয়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই আলোকে মূল স্থাপনা ঠিক রেখে ওপরে টাইলস বসানো হয়।

তিনি আরো বলেন, এই মসজিদ কমিটির সভাপতি মওদুদ আহম্মেদ দুদু খানসহ আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করেছি। এতে স্থানীয় মুসল্লিদের দান অনুদানের পাশাপাশি সরকারিভাবে পুকুর ঘাট ও ঈদগাহ নির্মাণের জন্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে প্রায় ৯ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি।

গত দু মাস পূর্বে এই মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে যোগ পেয়েছেন পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ বালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা শফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকেই এই মসজিদ স্থানীয়দের কাছে বেশ পরিচিত। অনেক লোক দূর থেকে এই মসজিদ দেখার জন্য আসেন এবং এখানে এসে নামাজ পড়েন। সাধারণ মানুষ এই মসজিদকে উসিলা করে নিয়ত-মানতও করেন। ওইসব লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, তাদের উপকার হয়েছে। এই মসজিদের খেদমত করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত এবং আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করছি।

চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাখাওয়াত জামিল সৈকত বলেন, বাখরপুরে এই ধরনের একটি পুরানো ঐতিহ্যবাহী মসজিদ আছে বলে জেনেছি এবং মসজিদটি দেখতে খুবই সুন্দর। এই মসজিদের আরো কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সেটি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা হবে এবং মসজিদে যাতায়াতের রাস্তাটি সংস্কারের জন্যে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এই বিষয়ে আমি ওই ইউনিয়নের প্রশাসককে অবগত করবো।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়