শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৫

সকল মাতৃভাষা চিরজীবী হোক

কাজী শাহাদাত
সকল মাতৃভাষা চিরজীবী হোক

পৃথিবীতে আজ অবধি যত আবিষ্কার হয়েছে, তার মধ্যে ভাষা আবিষ্কার করা ছিলো মানুষের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ অর্থপূর্ণ সহজ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষা অপরিহার্য এবং অত্যাবশ্যক। ভাষা বিজ্ঞানী টলারম্যানের মতে, মানুষের ভাষার ব্যবহারের ইতিহাস পঁাচ লাখ বছরের কম নয়।

ভাষা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘ইথনোলোগ’-এর তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে এ পর্যন্ত সাত হাজার নিরানব্বইটি ভাষা জীবিত আছে এবং আশঙ্কার কথা হলো এই, প্রতি পনের দিন অন্তর অন্তর একটা করে ভাষা মরে যাচ্ছে বা মুছে যাচ্ছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সপ্তম এবং মাতৃভাষা হিসেবে পঞ্চম স্থান দখল করে আছে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে ক্ষুদ্রায়তন বর্ণমালার ভাষা হচ্ছে ‘রোটোকাস’, যা পাপুয়া নিউগিনিতে ব্যবহৃত হয়। এর বর্ণমালার সংখ্যা মাত্র এগারোটি। আর সবচেয়ে দীর্ঘায়তনের বর্ণমালার ভাষা হচ্ছে কম্বোডিয়ার ‘ক্ষের’ ভাষা, যার বর্ণমালার সংখ্যা চুয়াত্তরটি। ‘বাদেশি’ নামের একটি ভাষা আছে, যা ব্যবহারকারী লোকের সংখ্যা মাত্র তিনজন। বুদ্ধের সময়ে ভিক্ষুসংঘে ‘বঙ্গীশ’ নামে একজন ভিক্ষু ছিলেন, যিনি ছিলেন স্বভাব কবি। কাজেই, এ তথ্য হতে সহজেই অনুমেয়, বাংলা ভাষার সূচনা অনেকদিন আগে থেকেই। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কার মোতাবেক বাংলা ভাষার আদিতম লিখিত নিদর্শন হলো চর্যাপদ, যা ঊনিশশো সাত সালে নেপালের রাজদরবার হতে তিনি আবিষ্কার করেন। ধারণা করা হয়, চর্যাপদের ভাষা ছিলো হেঁয়ালি ধরনের ভাষা বা সান্ধ্য ভাষা, যা থেকে বাংলা ভাষারূপে আজকের আধুনিক পর্যায়ে পেঁৗছেছে।

বাংলাভাষার লিখিতরূপ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি বাংলা বর্ণমালার উদ্ভাবক। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাকে গর্বিত করেছেন প্রথমবারের মতো বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঊনিশশো তেরো সালে তঁার গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে। কিন্তু ঊনিশশো সাতচল্লিশ সালে সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান দুভাগে বিভক্ত হলে, আমরা পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা পড়ে যাই পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্বপাকিস্তানে। শুরু হয় বাংলাকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের নতুন রূপ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ বাংলায় কথা বললেও কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কেবল উর্দুকেই ঘোষণা করেন। ফলে বাঙালির মধ্যে জেগে ওঠে দ্রোহ। নিজের মায়ের ভাষার মান রাখতে বাঙালি দ্বিধান্বিত হয়নি। সেদিন বৃহস্পতিবার, একুশে ফেব্রুয়ারি, ঊনিশশো বাহান্ন সালে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারেরা বুক চিতিয়ে রক্ত দিয়েছিলো বলেই আমরা ঊনিশশো ছাপ্পান্ন সালের ষোলো ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও সম্মানিত হতে দেখলাম।

পৃথিবীতে বাঙালিই প্রথম, যারা মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রক্ত দিয়েছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তিয়াত্তর বছর পার হতে চললো, তবুও আমরা আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের সঠিক হিসাব পেলাম না। কেউ বলেন চল্লিশ, কেউ বলেন ষোলো, কারও মতে এ সংখ্যা বারোজন আর কেউ কেউ বলেন তা নয়জনের মতো। কিশোর ভাষা শহীদ অহিদুল্লাহ কিংবা কোলের শিশুকে স্তন্যদাত্রী শহীদ মা আনোয়ারার কথা আজ কেউ আর বলে না। বাঙালির পরে ঊনিশশো একষট্টি সালে আসামের বরাক উপত্যকায়, শিলচর রেলস্টেশনে বাংলাভাষাকে রাজ্যভাষা করার দাবিতে ষোলো বছরের তরুণী কমলা ভট্টাচার্যসহ এগারোজন শহীদ হন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার আন্দোলনে ঊনিশশো ছিয়ানব্বই সালে শহীদ হন সুদেষ্ণা সিংহ। তারও আগে, নিজ মাতৃভাষা তেলেগু ভাষাভাষীদের জন্যে আলাদা রাজ্য চেয়ে একটানা ছাপান্ন দিন অনশন ধর্মঘটের পণ করে পনের ডিসেম্বর প্রাণ দেন গান্ধীবাদী পোট্টি শ্রীরামুলু, যঁাকে ভাষা শহীদ হিসেবে অমরজীবী শ্রীরামুলু নামে ডাকা হয়। ঊনিশশো ছিয়াত্তর সালের ষোলো জুনে দক্ষিণ আফ্রিকায় মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনে শহীদ হন পিটার হেক্টর নামের বারো বছরের এক কিশোরসহ কুড়িজন ছাত্র। এভাবেই দিকে দিকে কালে কালে মাতৃভাষার জন্যে মানুষ আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে। আর এক্ষেত্রে বাঙালিই হলো প্রথম পথ প্রদর্শক।

শুধু তাই নয়, মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড সংগঠনের উদ্যোগে, কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক রফিক ও সালামের প্রচেষ্টা ও তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের দূরদর্শিতায় বাংলা ভাষা আন্দোলনের অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকেই ইউনেস্কো এবং জাতিসংঘ ঘোষণা দেয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। তারই ধারাবাহিকতায় ঊনিশশো নিরানব্বই সালের সতের নভেম্বর প্রাপ্ত স্বীকৃতি অনুযায়ী দুহাজার সালের একুশে ফেব্রুয়ারি হতে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে এবং দুহাজার দশ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি হতে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। বাঙালি ও বাংলা ভাষার জন্যে এ এক অপার গৌরবের।

বাংলা ভাষা নিয়ে মধ্যযুগ হতেই ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে আসা বাঙালির পক্ষে ‘বঙ্গবাণী’র কবি আব্দুল হাকিম ক্ষোভ ঝেড়ে বলেছিলেন,

‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী

সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’

সেই ষড়যন্ত্র আজও থামেনি। আজও বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষীরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষার তকমা দিয়ে দূরে ঠেলে রাখে, আর যান্ত্রিক যুগের নতুন মানুষদের কাছে বাংলা ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে অচল সিকির মতো। আজ জাতীয় শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এই পবিত্র ক্ষণে তাই দুঃখ বোধ করছি আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি গোষ্ঠী বিশেষের এই অবজ্ঞা প্রত্যক্ষ করে।

বুকের রক্তে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেলেও স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার জন্যে অনেক চেষ্টা করে গেছেন বিজ্ঞানী সত্যেন বোস, ড. কুদরত-ই খুদা প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিবর্গ। কম্পিউটারে বাংলা প্রচলনে শ্রম দিয়েছেন ডা. মেহেদি হাসান এবং মোস্তফা জব্বার। অভ্র ও বিজয়ের বাংলা ফন্টে আজ প্রযুক্তিতেও বাংলা ভাষার জয় জয়কার। স্মার্ট ফোনেও আজ আমরা বাংলা হরফ চালু করতে পেরেছি।

বাংলাদেশ এবং আসাম ছাড়া আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনেও বাংলা ভাষা আজ দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। এর কৃতিত্ব আমাদের শান্তিরক্ষা মিশনের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর।

অমর একুশে আমাদের মাথা নত না করার চেতনা দিয়েছে, দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার সাহস। আমাদের ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত আছে একাত্তরের সুমহান বিজয়ের বীজমন্ত্র। তাই একুশ আমাদের আত্ম পরিচয়ের নির্মাতা।

অত্যন্ত বেদনার সাথে বলতে হয়, আজকের প্রযুক্তি-অন্ধ প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার মূল্য ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। পারস্পরিক যোগাযোগের জন্যে তারা নিজেদের মধ্যে একধরনের যান্ত্রিক ভাষা রপ্ত করে নিয়েছে, যা না বাংলা, না ইংরেজি। বিকৃত উচ্চারণে বাংলা বলা এবং ভুল বানানে বাংলার চর্চা যেমন আমাদের আহত করে, তেমনি নাটকে-সিনেমায় বাংলাকে অশ্লীলভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ অনুরাগ তৈরি করতে পারছে না। জাতির স্বার্থে এ অবস্থা থেকে আশু পরিত্রাণ কাম্য।

আজকের এ শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাদের একটাই আবেদন, মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ ও পরিসর বাড়াতে হবে এবং প্রয়াসকে অবিরত রাখতে হবে। নচেৎ বাঙালির পক্ষে বিজ্ঞানকে হৃদয়ঙ্গম করা যেমন দুরূহ হবে তেমনি তা আর কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানেরও উন্মেষ ঘটাবে না। আজকের এই পুণ্য লগনে সকল ভাষা শহীদের স্মৃতিতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই,

মোদের গরব মোদের আশা

আ-মরি বাংলা ভাষা।

বাংলা ভাষা চিরজীবী হোক, বিশ্বজয়ী হোক। পৃথিবীর সকল মানুষের মাতৃভাষা বেঁচে থাকুক, সচল থাকুক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়