প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৪
এমন মহতী উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে

'পবিত্র মাহে রামজান উপলক্ষে ফরিদগঞ্জে ক্রয়মূল্যে ও ভাটিয়ালপুরে এক টাকা লাভে পণ্য বিক্রি' শিরোনামে সংবাদটি চাঁদপুর কণ্ঠে ছাপা হয়েছে গত সোমবার। প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো সংবাদটিতে প্রবীর চক্রবর্তী লিখেছেন, পবিত্র মাহে রমজানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ ইউরোপের অনেক দেশে দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে ইফতার সামগ্রীর দাম কমালেও বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির যাঁতাকলে পড়তে হয় রোজাদারদের। সিন্ডিকেটগুলো এবং বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে করলে দাম কমানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। কিন্তু তারা না করলেও গত দুবছর ধরে ফরিদগঞ্জ পৌর এলাকার চরকুমিরা গ্রামের শাহ আলম মাল নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইফতারি ও নিত্য প্রয়োজনীয় ৮টি সামগ্রী এক টাকা লাভে বিক্রি করছেন। মানুষের ভালোবাসা দেখে তিনি এ বছর আরো এক ধাপ এগিয়েছেন। তিনি ক্রয়মূল্যেই বিক্রি শুরু করেছেন নির্দিষ্ট ৮টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। শুধু তা-ই নয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকারের পুরস্কার পাওয়া শাহআলমের এই কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছে পার্শ্ববর্তী ভাটিয়ালপুর পুরাণবাড়ি যুবসমাজ। তারাও এ বছর থেকে ভাটিয়ালপুর চৌরাস্তায় এক টাকা লাভে নিত্য প্রয়োজনীয় ৮টি সামগ্রী বিক্রি শুরু করেছেন।
সরজমিনে গিয়ে জানা গেছে, চরকুমিরা গ্রামের শাহ আলম মাল বিগত দুবছরের ন্যায় চলতি বছরেও মাহে রমজান উপলক্ষে ছোলা, খেসারির ডাল, বেসন, মুড়ি, চিড়া, চিনি, খেজুর, সয়াবিন তৈল ক্রয়মূল্যে বিক্রি শুরু করেন। বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-ইমরান বিক্রি কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। শাহ আলম মাল জানান, মাহে রমজান সিয়াম সাধনার মাস। আমি বিগত ১১ মাস ব্যবসা করেছি। এই এক মাস আখেরাতের জন্যে ব্যবসা করলাম না। তাছাড়া আমি ক্রয়মূল্যে ৮টি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রির কারণে জনগণ উপকৃত হচ্ছেন, সাড়া পাচ্ছি বেশ, এতেই আমি খুশি। আমি চাই আমার দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসুক। আমি বিগত দুবছরে ভালো সাড়া পেয়েছি। বছরের অন্যান্য সময়ে মাসে গড়ে এক/দেড় লক্ষ টাকা বিক্রি করলেও রমজান মাসে তা ৭/৮ লক্ষ টাকায় পৌঁছে। এ বছর আরো বাড়বে। 'ক্রয় মূল্যে বিক্রি করে কীভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাবেন' এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি তার সামনে থাকা একটি অর্ডার কপি দেখিয়ে বলেন, কিছুক্ষণ পূর্বে বিদেশ থেকে আমার কাছে অর্ডারটি এসেছে। নির্ধারিত ৮টি পণ্যের বাইরেও তার অনেক পণ্য রয়েছে। সেখান থেকে তো আমি লাভ করেছি। আমি সকলের সহযোগিতা পাচ্ছি। এই মাসে নেকের কাজ করাও একটি ভালো কাজ। শাহ আলমের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে সদ্য প্রবাস ফেরত সাহাবুদ্দিন বলেন, সৌদি আরবে থাকাকালীন আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাহ আলম ভাইয়ের এই উদ্যোগের কথা জেনেছি। দেশে ফিরে আমি নিজেই তার ক্রেতা হয়ে গেলাম। শুধু শাহ আলম নয়, রমজানকে সামনে রেখে এদেশের সকল ব্যবসায়ীকে মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বড়ো বড়ো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এই রমজানকে ঘিরে নিজেদের ব্যবসায় বেশি লাভ করার চেষ্টায় থাকেন, যা অনুচিত। সরকারের উচিত এই জাতীয় উদ্যোগকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া। স্থানীয় সলেমান, শামছুল হক পাটওয়ারী, কালামসহ মালামাল ক্রয় করতে আসা লোকজন জানান, শাহ আলমকে দেখে ব্যবসায়ীদের শিক্ষা নেয়া উচিত। অন্তত একটি মাস ব্যবসার কথা না ভেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো তাদেরও কর্তব্য। আমাদের এলাকায় শাহ আলম এই উদ্যোগ নেয়ায় আমরা খুশি। এদিকে চলতি বছর থেকে পৌর এলাকার ভাটিয়ালপুর পুরাণবাড়ি যুবসমাজ ১৪টি পণ্য এক টাকা লাভে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্যে তারা ভাটিয়ালপুর চৌরাস্তার ওয়াসিম কসমেটিকস স্টোরকে বেছে নিয়েছে। ওয়াসিমের দোকানেই পবিত্র শবেবরাতের দিন থেকে মালামাল বিক্রি শুরু করেছেন। উদ্যোক্তা ওয়াসিমসহ অন্যরা জানান, এ বছর আমরা এক টাকা লাভে এই পণ্য বিক্রি শুরু করেছি। আশা করছি অন্যরাও এগিয়ে আসবে। যুব সমাজের একজন ও দোকানের কর্ণধার ওয়াসিম জানান, আমরা ভাটিয়ালপুর পুরাণবাড়ি যুবসমাজ এই এলাকার কর্মজীবী সাধারণ মানুষজনের কথা ভেবে মাত্র এক টাকা লাভে নির্ধারিত ১০টি পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেই। যেই কথা সেই কাজ। শবেবরাতের দিন থেকে আমরা মুড়ি, ছোলা, খেসারি ডাল, চিড়া, চিনি, বেসন, খেজুর, তৈল, মসুরির ডাল, আটা খোলা ও প্যাকেট, পেঁয়াজ, রসুন বিক্রি করে চলছি। তিনি জানান, আমরা যেই মূল্যে ক্রয় করবো তার থেকে এক টাকা লাভে বিক্রি করবো। মানুষ একটি সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে পারছে, এটাই আমাদের বড়ো পাওয়া। ধানুয়া থেকে পণ্য কিনতে আসা কামাল খান, ভাটিয়ালপুর গ্রামের টুটুলসহ অন্যরা জানান, তারা এই রমজানে এক টাকা লাভে পণ্য কিনতে এসে ন্যায্যমূল্যে মাল পেয়ে খুশি। আমরা নিজেরাও যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করছি। তাছাড়া এই উদ্যোগের মতো ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসলে রোজাদাররা উপকৃত হবেন। স্কুল শিক্ষক তপন কর্মকার জানান, সিয়াম সাধনার মাসে ভাটিয়ালপুর পুরাণবাড়ি যুবসমাজের এক টাকা লাভে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ মহতী কাজ। এই উদ্যোগ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া উচিত। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-ইমরান বলেন, শাহ আলমরা আমাদের আইকন। অন্তত রমজান উপলক্ষে যদি বড়ো ব্যবসায়ীরা এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে সাধারণ ক্রেতারা অনেক উপকৃত হবে।
ফরিদগঞ্জের ব্যবসায়ী শাহআলম নিজ থেকে রমজান উপলক্ষে যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটি নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়। ইতোমধ্যে তাঁকে অনুকরণ শুরু হয়ে গেছে, যেটি শুভ লক্ষণ। শাহআলম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়েও বড়ো উদ্যোগ নিয়ে বড়ো ব্যবসায়ীদের লজ্জার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন কিংবা প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন। এর ফলে ভোক্তা/ক্রেতারা সচেতন হয়ে প্রতিবাদ করতে শিখবে এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে প্রতিহত করার জন্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবে। উৎসব-পার্বণে অতিরিক্ত লাভ নয়, বিশেষ ছাড়-এমন মানসিকতায় ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করতে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিতে পারে কর্মসূচি। আমরা সেই অপেক্ষায় থাকলাম।