রবিবার, ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২১

বাংলাদেশ বিমানের অবহেলায় ভাইকে শেষ বিদায় দিতে পারেননি প্রবাসী বাংলাদেশি

ফাতেমা রহমান রুমা, জার্মানি থেকে
বাংলাদেশ বিমানের অবহেলায় ভাইকে শেষ বিদায় দিতে পারেননি প্রবাসী বাংলাদেশি

জার্মানিতে বসবাসরত এক বাংলাদেশী প্রবাসী রেজাউল করিম সিদ্দিকী, শেষবারের মতো মৃত ভাইকে দেখতে দেশে ফেরার সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তাদের অবহেলা ও দুর্ব্যবহারে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। আবুধাবি বিমান বন্দরে তিনি যখন ফ্লাইটে উঠতে চেয়েছিলেন, তখন কর্মকর্তারা দাবি করলেন যে, তার নামে কোনো টিকিট নেই। বিষয়টি নিয়ে তিনি ব্যাপকভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং বিমান কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা চান। কিন্তু কর্মকর্তারা কোনো সহযোগিতা না করে উল্টো তার সাথে দুর্ব্যবহার করেন। এই অবহেলার কারণে বাধ্য হয়ে বিকল্প উপায়ে বাড়তি ব্যয়ে ৪৮ ঘন্টা পর রেজাউল দেশে ফিরতে অনেক দেরি করেছেন। ফলে ভাইকে শেষবারের মতো দেখা ও মৃত ভায়ের দাফনের শেষ সুযোগ হারিয়েছেন। অথচ পরবর্তীতে তার নামের টিকিটটি সার্ভারে পাওয়া গেছে।

এসব কিছুর জন্যে আবুধাবিতে কর্মরত বিমানের কর্মকর্তাদের চরম দায়িত্বহীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ী করেছেন রেজাউল করিম। তার অভিযোগ, বিমানের কর্মীরা তাকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করে উল্টো চরম দুর্ব্যবহার করেছেন। নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বর্ণাতীত অবমাননাকর ঘটনার জন্যে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ১শ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন তিনি। রেজাউল করিম সিদ্দিকী ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে কিছুদিন চাকরি করার পর জার্মানিতে গিয়ে সেন্সর টেকনোলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। গত ১১ বছর যাবৎ তিনি সপরিবারে জার্মানিতে বসবাস করছেন এবং সেখানেই কর্মরত আছেন।

গত শনিবার জার্মানী থেকে রেজাউল করিম এই প্রতিবেদকের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। করোনা মহামারিতে তাঁর ছোট বোনকে হারানোর পর তার ভাগ্নিদের দেখাশোনা করছিলেন তাঁর বোনের স্বামী জয়নাল আবেদিন লিটন। হঠাৎ লিটনের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পেয়ে রেজাউল দ্রুত দেশে ফিরার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দেশে পৌঁছানোর আগেই লিটনের মৃত্যুর খবর পান।

তিনি জানান, “প্রথমে জার্মানির মিউনিখ বিমান বন্দর থেকে গ্রীস, এরপর সেখান থেকে আরেকটি ফ্লাইটে আবুধাবি বিমান বন্দরে পৌছাই। সেখান থেকে ১১ জানুয়ারি স্থানীয় সময় রাত পৌনে তিনটায় বিমানের একটি ফ্লাইটে (বিজি ৩২৮) ঢাকায় পৌছানোর জন্যে আগে থেকেই টিকিট (নম্বর ৯৯৭৩৪৯৬১৮৪৮৩৭) কিনেছিলাম। কিন্তু বিমান বন্দরে বিমানের কাউন্টারে গিয়ে বোর্ড পাস সংগ্রহ করতে গেলে সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা (বাংলাদেশী নাগরিক) জানান, আমার নামে কোন টিকিট নাকি তাদের সার্ভারে নেই। চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যেও তাদেরকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি, মৃত ভাইয়ের কথা বলি, আমার টিকিটের সপক্ষে নানা প্রমাণ দেখাই। কিন্তু কিছুতেই তাদের মন গলেনি। উল্টো আমার সঙ্গে চরম দুর্ব্যাবহার করেন। এক পর্যায়ে তাদেরকে বললাম, আমি জার্মানী থেকে আরও দুইটা ফ্লাইটে এসেছি। টিকিট ছাড়া তো আসা সম্ভব নয়। তাদের ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস সংগ্রহের জন্য শুধু আমার নাম বললেই তারা তা দিয়েছে। আপনারাও আমার নাম দিয়ে একটু খুঁজে দেখতে পারেন। এ কথা শুনেই বিমানের একজন কর্মকর্তা লাফ দিয়ে উঠে বলেন, আপনার কাছে কী আমার কাজ শিখতে হবে? যান। এক পর্যায়ে ওই কর্মকর্তা তার আসন ছেড়ে চলে গেলেন,’ যোগ করেন রেজাউল।

রাত আড়াইটার দিকে বিমানবন্দরে একা দাঁড়িয়ে রেজাউল বুঝতে পারলেন, তিনি এক চরম দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন। বাংলাদেশে ফেরার পরবর্তী ফ্লাইটের জন্যে এত রাতে আবুধাবিতে আটকে পড়া তাঁর জন্য এক দুঃস্বপ্ন ছিল। কিন্তু রাতে সবাই ঘুমিয়ে থাকায় পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি চরম বিপাকে পড়েন।

রেজাউল বলছিলেন, ‘প্রায় ১২ ঘন্টার জার্নি, তার উপর স্বজন হারানোর ব্যথা। এর মধ্যে বিমানের কর্মকর্তাদের এমন দায়িত্বহীনতায় আমি হতবাক ছিলাম। আমার তখন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। পাগলের মতো বিমানবন্দরের ভেতর হাঁটছি। এক পর্যায়ে সেখানে একজন বাংলাদেশীর সঙ্গে দেখা হলো। তার পরামর্শে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ১৫০ কিলোমিটার দূরে দুবাই গেলাম। দুবাই বিমান বন্দরে পরিচিত একজনের সঙ্গে যোগাযোগের পর রাত সাড়ে ৯ টায় ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে নতুন করে টিকিট কিনতে হয় আমার। ওই ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছে নিজ বাড়ি টাঙ্গাইল গিয়ে দেখি লিটনের দাফন শেষ।’

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই জার্মান নাগরিক জানান, ‘নিজের মানসিকতা একটু স্বাভাবিক হলে কয়েকদিন পর ঢাকার ফার্মগেটে বিমানের কার্যালয়ে বলাকায় গিয়ে অভিযোগ করি। সেখান থেকে আমাকে মতিঝিলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকার পর মতিঝিলে বিমানের এক কর্মী আমার পিএনআর নম্বর দিয়ে চেক করে বলে আপনার নামে টিকিট তো ছিলো। সেটা এখনও (অনসময়) সার্ভারে দেখাচ্ছে। এক পর্যায়ে আমার অনুরোধে তিনি একটি প্রিন্ট কপিও আমাকে দিলেন।’

রেজাউলের অভিযোগ শুনে বিমানের কর্মচারী দায় স্বীকার করে নিলেন। তিনি বললেন, “এই সমস্যার জন্যে আসলে আবুধাবিতে কর্মরত তাদের সহকর্মীরা দায়ী। “রেজাউল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাই আজীবন বহন করবে এই অসহ্য যন্ত্রণা। বিশেষ করে যখন করোনায় মা হারানো আমার এতিম দুই ছোট ভাগ্নি, বাবা হারানোর উত্তপ্ত বেদনা আর কষ্টে জর্জরিত, তখন তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি।’

‘জার্মানিতে ১২ বছরের সফল ইতিহাসে এমন ঘটনা শুধু আমার ব্যক্তিগত ট্রাজেডিই নয়, সন্মানিত সকল রেমিট্যান্সযোদ্ধার জন্যে শোকের এবং লজ্জার। সাথে সাথে আমরা বিদেশে পড়ে থেকেও যাদের আত্মা এই দেশের আলো-বাতাস-মাটিতে পড়ে থাকে, সেই বাংলাদেশের জন্যে এটি একটি লজ্জা ও কলঙ্কময় ঘটনা,’ যোগ করেন তিনি। ক্ষুব্ধ কন্ঠে রেজাউল বললেন, ‘বাংলাদেশ বিমানের অব্যবস্থাপনা আর স্বেচ্ছাচারিতায় শেষবার ভাইয়ের মুখখানি তো দূরের কথা, শেষ বিদায়ের জানাজায় পর্যন্ত থাকতে পারিনি। আমি চাই, আমার বোনজামাইয়ের মৃত্যু ব্যর্থ না হোক। আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার চাই। আমি চাই, আমার মতো আর কেউ যেন এমন অসহনীয়-অপূরণীয় ক্ষতির শিকার না হয়। এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলেও জানান তিনি। -জার্মান প্রবাসী রেজাউল করিম সিদ্দিকী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়