প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০১
প্রবীণ পেশাদার সেবা কর্মীর গুরুত্ব
প্রবীণ জীবন নিয়ে উন্নত দেশগুলো যতটা চিন্তা করে আমাদের দেশে ততটা চিন্তা এখনো করে না। আমাদের দেশের প্রবীণরা বেশিরভাগই নিয়তি এবং সন্তান নির্ভর। সমাজ ব্যবস্থায় নানা রকমের পরিবর্তনগুলো মানতে চায় না। নিজেদের সময় কালকে বিবেচনায় নিয়ে মতামত দিতে থাকে। আমরা চাই বা না চাই প্রতিনিয়ত সমাজ পরিবর্তন হয়ে নতুন চিন্তা ভাবনা সামনে এসে হাজির হচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে কাজের ধরণ, কর্মক্ষেত্র, কাজের পরিবেশ, পারিশ্রমিক, কাজের ঘন্টা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। সরকারি সংস্থা এটুআই এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পর দেশে ৫৪ লাখ কর্মী চাকরি হারাতে পারেন। পোশাক খাতে ২৭ লাখ, ফার্নিচারে ১৪ লাখ, কৃষি পণ্য ও পর্যটন খাতে ৬ লাখ করে মোট ১২ লাখ, চামড়া শিল্পে ১লাখ। অর্থনীতিতে নানা আশঙ্কার পাশাপাশি বিপুল সম্ভাবনাও তৈরি হয়। গবেষকরা সেবা খাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, হিসাব সংরক্ষণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরামর্শ, শল্যচিকিৎসা, কলকারখানায় নিয়ন্ত্রণ, অফিস আদালতে ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ, গণপরিবহন চলাচল, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যাবে। অন্যদিকে যন্ত্রনির্ভর জীবন মানুষের সামাজিক জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। কাজের জায়গা ঢিলেঢালা ভাব রহিত হয়ে কর্মমুখর হয়ে উঠবে। কাজের চাপ মানুষের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনকে প্রাণহীন, সৌজন্যমূলক, হাই, হ্যালোর মধ্যে আটকে দিবে। বস্তুগত অর্জন এবং সুখ ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনকে চরম নিঃসঙ্গ করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় হোক আমাদেরকে অবসর জীবনে চলে আসতে হবে। নিজের দায় দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যক্তির উপর চলে আসতে পারে। নির্ভরশীলতা প্রবীণ জীবনে অপরিহার্য একটি বিষয়। অতি প্রবীণরা প্রায়ই নিঃসঙ্গ অবস্থায় বসবাস করেন। যারা ছেলে-মেয়ের সাথে থাকার সুযোগ পান তারা ও সন্তানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার তেমন একটা সুযোগ পান না। সন্তানরা তাদের কর্মজীবন, সন্তান সন্তুতি, বন্ধু-বান্ধব, সামাজিকতা নিয়ে বেশ খানিকটা ব্যস্ত থাকেন। আত্মতুষ্টির জন্য কেউ কেউ দাবি করেন সন্তানের সাথে সন্তানের সাথে তার যাপিত জীবন খুবই আন্তরিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এসব দাবি অস্বীকার করার জো নেই। কথা হলো, কতজনের এমন সৌভাগ্য হয়?
|আরো খবর
এটি প্রমাণিত সত্য যে, মানুষ শেষ পর্যন্ত একা। একা হয়ে যাওয়া কিংবা নিঃসঙ্গ জীবনযাপনকে শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারা সাহসের বিষয়। এই সাহস সবাই রাখতে পারে বলে মনে হয় না। নিঃসঙ্গ একাকী প্রবীণ জীবনকে শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক করতে পেশাদার সেবা কর্মীর প্রয়োজন। অসুস্থ অবস্থায় কিংবা দুর্বল শরীরে দৈনন্দিন কাজকর্ম কারো সাহায্য ছাড়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি প্রবীণের মধ্যে কয়েক লাখ প্রবীণ রয়েছে যাদের সেবা কর্মী প্রয়োজন। খুব অল্প সংখ্যক প্রবীণ রয়েছে যারা উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সেবা কর্মী রাখতে পারেন। ভবিষ্যতে সামর্থ্যবান প্রবীণের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। পেশাদার সেবা কর্মীর চাহিদা বাড়বে। সেবা কর্মীর চাহিদা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করি না।
সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী কমপক্ষে এক বছরের একটি সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা দরকার। প্রথম ছয়মাস শ্রেণি কক্ষে তত্ত্বীয় শিক্ষা গ্রহণ এবং বাকি ছয়মাস হাসপাতাল কিংবা সেবা কেন্দ্রে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ শেষে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আয়োজন করে সেবাকর্মীদের লাইসেন্স দিতে হবে। লাইসেন্স প্রাপ্ত সেবা কর্মীরা হবে পেশাদার সেবা কর্মী। সেবা কর্মীর দায়দায়িত্ব, কর্তব্য, নিরাপত্তা, পারিশ্রমিক, ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ- সুবিধা বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হবে।
সেবা কর্মীরা যেমন সেবা দেবার দক্ষতা অর্জন করবে এবং একই সাথে অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান সেবা সম্পর্কে হাল নাগাদ তথ্য থাকবে। সেবা কর্মী বাসা বাড়িতে, হাসপাতালে, রোগ প্রশমন কেন্দ্রে প্রবীণের পাশে সাহস এবং নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে উপস্থিত থাকবে। সেবা কর্মীরা জরুরি ভিত্তিতে দুর্গম এলাকা থেকে অসুস্থ প্রবীণকে চিকিৎসার জন্যে উপযুক্ত হাসপাতালে আনতে পারবে। প্রবীণকে নিজ গৃহে অথবা তার পছন্দের জায়গায় চাহিদা মোতাবেক সেবাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
প্রবীণরা পয়সা খরচ করে মানসম্পন্ন পেশাদার সেবা কর্মী থেকে সম্মান, মর্যাদা, সৌজন্যতা লাভের অধিকারী। প্রবীণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে সেবা কর্মীর কাছ থেকে সেবা ক্রয় করেছে এটা মনে রাখতে হবে। সেবা কর্মীর আচার-আচরণ চলাফেরা শোভন হতে হবে। পরিবারের কোনো সদস্য কিংবা আত্মীয়-স্বজনের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা বা স্থাপন গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। সেবা কর্মীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করলে সমাজে এই পেশার গুরুত্ব বেড়ে যাবে। অর্থ বিত্ত সহায় সম্পদ মানুষকে মানবিক করার পরিবর্তে যান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত করে তুলছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
মানুষ বেছে নিয়েছে যন্ত্রণাদায়ক যান্ত্রিক জীবন। প্রকৃতিবিরুদ্ধ এই যান্ত্রিক জীবন যুদ্ধ বিগ্রহ, ঝড় তুফান, বন্যা জলোচ্ছ্বাস, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, খরা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাড়ি গাড়ি, সহায় সম্পদ, অর্থ বিত্ত, ক্ষমতার দাপট এসব অর্থহীন উঠে জীবনের শেষ দিনগুলোতে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় থাকে না কোনো আপনজন। মরার পরও কাউকে লাশ ঘরে অপেক্ষা করতে হয় স্বজনের জন্যে।
চোখ ভরা জল নিয়ে, ছল ছল করে তাকিয়ে, হাতখানি ধরে পাশে বসে থাকার আপনজন সবার কপালে জোটে না। এই সময়টাতে পেশাদার সেবা কর্মী মৃত্যুপথযাত্রী প্রবীণের পাশে থেকে অন্তিম ইচ্ছে পূরণের চেষ্টা করে। চেনাজানাহীন সেবা কর্মীর হাত ধরে শেষ যাত্রার দৃশ্য কল্পনা করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়।
সমাজের প্রয়োজনে পেশাদার সেবা কর্মীর আগমন। তাদেরকে সমাজে মর্যাদা সম্মানের সাথে অধিষ্ঠিত করতে পারলে প্রবীণদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমবে।