প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৩
প্রবীণ জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকা
স্ত্রীর জীবনে স্বামী আলোকবর্তিকা হিসেবে এখনো বিরাজমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ সংসার, সন্তান, পরিবার, সহায় সম্পদের অভিভাবক হিসেবে কাজ করছে। অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যর্থতা কিংবা বাড়াবাড়ি থাকে, ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রাগ- ক্ষোভের জন্ম হয়।রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সাধারণত স্ত্রীর মাধ্যমে হয়ে থাকে। পরিবারের ভালো-মন্দ নিয়ে স্বামীর সাথে দরকষাকষি স্ত্রীকেই করতে দেখা যায়। স্বামী বার্ধক্যে পৌঁছে গেলে সংসার- পরিবারে কর্তৃত্ব, খবরদারি দুর্বল হতে থাকে। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে যায়। তারাই বেশিরভাগ সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
|আরো খবর
স্বামীর ব্যর্থতা, অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা, সিদ্ধান্তহীনতা স্ত্রীকে বিচলিত করে তোলে। স্বামীর সফলতা, সহায় সম্পদ স্ত্রীকে নিরাপদ ভবিষ্যতের প্রতি আস্থাশীল হতে সাহায্য করে। আবার স্বামীর ব্যর্থতা এবং সহায় সম্পদের অভাব স্ত্রীকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিশেহারা হয়ে উঠে।
প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে স্বামী দিন দিন স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল হতে থাকে। চিকিৎসা, সেবা-যত্ন, ওষুধপত্র, খাবারদাবার সহ যাবতীয় কাজে স্ত্রীর মতামতকে প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। অনেক 'বাঘ' স্বামী বিড়ালে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়। শারীরিক ও আর্থিকভাবে দুর্বল হতে থাকলে স্বামী বেচারা নানান রকমের অবহেলার শিকার হন।
যেসব স্বামী যৌবনে ঘুষ-দুর্নীতি, অনাচার, পরকীয়া, স্বজনপ্রীতি, মাদক সেবনে লিপ্ত ছিলেন, তারা সকল সময়ই সমাজে নানাভাবে সমালোচিত হন।তাদের অর্জিত সহায় সম্পদকে সাধারণ মানুষ ভয় এবং ঘৃণার চোখে দেখে। সমাজে এদের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে থাকায় স্ত্রীর কাছে আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। স্ত্রীর নামে বাড়িঘর, জমিজমা, সঞ্চয়পত্র, স্থায়ী আমানত, ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছু অংশ দিতে দেখা যায়। স্ত্রীর অসুস্থতায় স্বামী বেশি উদগ্রীব হয়ে পড়েন। স্ত্রীর চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে দেখা যায়। ছেলেমেয়ে আত্মীয় স্বজনকে স্ত্রীর অসুস্থতার সংবাদ জানিয়ে সহযোগিতা ও দোয়া কামনা করেন।
যারা সারাজীবন স্ত্রীর প্রতি সঠিক ভূমিকা পালন করেননি কিংবা সুযোগ পাননি তাদের মধ্যে এক ধরনের অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায়। সেই অনুশোচনা থেকে কেউ কেউ স্ত্রীর প্রতি দরদি হয়ে উঠেন। মনে মনে স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেন কিনা এমন স্বামী সম্পর্কে অবহিত নই।
সামর্থ্যবান স্বামীরা জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী জাঁকজমকভাবে পালনে উৎসাহিত হয়ে উঠেন। মুখ খুলে না বললেও সন্তান সন্তুতিদের এমন আয়োজন দারুণভাবে উপভোগ করেন। স্ত্রীকে উপহার দিয়ে এবং নিজে উপহার পেয়ে খুশি হন।
যৌবনে নষ্ট হওয়া মানুষ এসে কামেল কিংবা মহাপুরুষ হয়ে যায় না। অপরাধ করা মন সহজে বশ মানে না, সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই নষ্ট হওয়া মুখোশধারী স্বামী তার স্ত্রীকে নানান রকমের যন্ত্রণায় ফেলে জীবন অতিষ্ঠ করে দেন। এসব কারণে অনেক সময় স্ত্রীরা স্বামীকে কঠিন নজরদারিতে রাখেন। যে কোনো ধরনের নজরদারি স্বামীদের দারুণ অপছন্দের একটি কাজ। নজরদারি, জবাবদিহিতা, মরাল পুলিশিং স্বামীকে আগ্রাসী ভূমিকায় নিয়ে যায়।
কোনো কোনো স্বামী নিজেকে সকল সামাজিক কাজ থেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন। পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। অনেকে ধর্মকর্ম নিয়ে মনোযোগী হয়ে উঠেন। পৃথিবীর প্রতি তেমন একটা আকর্ষণ বোধ করেন না। কেউ কেউ চিকিৎসা নিতে এবং ওষুধপত্র সেবনে আগ্রহী হন না বরং মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকেন।
কিছু কিছু স্বামী নিজের সকল অক্ষমতার দায়ভার স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেন। স্ত্রীর প্রতি অশোভন আচরণ, অবহেলা করে প্রতিশোধ নিতে চান।তারা মনে করেন, সংসারে যে সহায়-সম্পদ অর্জন করেছেন সেই সম্পদ দিয়ে সবার জীবনযাপন সহজ হয়েছে। অথচ তার নিজের জীবনই বেশি কষ্টের মধ্যে পড়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা মায়ের পক্ষ নেয় কিংবা সমর্থন করে। ফলে স্বামীর রাগ-ক্ষোভ স্ত্রীকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। কখনো কখনো অসহায় স্বামীকে স্ত্রীর আয়- রোজগারের ওপর জীবন নির্বাহ করতে দেখা যায়। প্রবীণ স্বামীকে স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে ভিক্ষা করার এমন দৃশ্যও মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
স্ত্রীর ভূমিকা
প্রবীণ জীবনে স্ত্রীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেবা-যত্ন, ওষুধপত্র, খাবারদাবার ইত্যাদি বিষয়ে স্ত্রীর নজরদারি থাকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দাম্পত্য জীবনে স্বামীকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার রেওয়াজ চালু রয়েছে। কার্যত সংসারে স্ত্রীর অভিভাবক স্বামী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বামীর আয়ে সংসার চলে। যেসব স্ত্রী কর্মজীবী তারা যৌথ ভাবে সংসারের খরচ বহন করে। বয়সের পার্থক্য থাকার কারণে স্বামীকে আগেভাগেই নানান রকমের রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পক্ষাঘাতগ্রস্ততা, স্ট্রোক, পারকিনসন্স, ডিমেনশিয়া, আলঝাইমার্সে আক্রান্ত স্বামীর দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব স্ত্রীর কাঁধে পড়ে। সে সময় ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পিতার সেবা-যত্ন- চিকিৎসায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন খুবই কঠিন বিষয়। সন্তানরা ক্ষেত্র বিশেষ আর্থিক সহায়তা করে কিংবা খণ্ডকালীন সেবা-যত্নে অংশগ্রহণ করে।
স্বামীর চিকিৎসায় সেবা-যত্নে মূল দায়িত্ব পালন করতে হয় স্ত্রীকে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অসুস্থ স্বামীর শয্যাপাশে নির্ঘুম রাত্রি যাপনের কষ্টকর স্মৃতি অনেক স্ত্রীর রয়েছে। স্ত্রীর ছুটি নেই, বেড়াতে যাবার সুযোগ থাকে না, নিজের ইচ্ছামতো বিশ্রাম নিতে পারে না। অনেক স্ত্রী সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন না। সামাজিক সমালোচনার ভয়ে আনন্দ উৎসবে, হাসি ঠাট্টায়, দূরের ভ্রমণে, গান বাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, নাটক-সিনেমায় অংশ নিতে পারেন না। উল্টো ধর্ম কর্মে অধিক মনোযোগী হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে দেখা যায়। স্বামীর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা না থাকলে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়।অসুস্থ স্বামীর শয্যাপাশে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করা স্ত্রীর মানসিক অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। ছেলেমেয়ে, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা আসে, কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যায়। স্ত্রীকে সবসময়ই পাশে থাকতে কিংবা নজরদারি করতে হয়। যেসব স্বামীর আর্থিক অবস্থা খারাপ কিংবা চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফতুর হয়ে গেছেন, তাদের স্ত্রীরা আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার কর্জ, সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালান।
যেসব স্ত্রী যৌবনে স্বামীর অবহেলা, নির্যাতন, অপমান, অসম্মানের শিকার হয়েছেন, তারা স্বামীর সেবা-যত্ন আন্তরিকভাবে করেন না কিংবা করতে চান না। যে সকল স্ত্রীর স্বামী শারীরিকভাবে মোটামুটি সুস্থ এবং চলাফেরা করতে সক্ষম তারা কম-বেশি ভালো আছেন। স্বামীর সাথে ঝগড়া করে, গল্প করে, অভিমান করে, শপিং করে, ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটিয়ে নিচ্ছেন। বয়স বাড়তে থাকলে চলাচল সীমিত হয়ে যায়। বন্ধু বান্ধবের সাথে দেখা- সাক্ষাৎ, যোগাযোগ কমে যায়, আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক শুকনো হয়ে পড়ে। রক্তের সম্পর্কের লোকজনের সাথে স্বার্থের দ্বন্দ্বগুলো প্রকাশ্যে চলে আসে।
স্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ স্বামীকে দারুণ অপছন্দ করেন। তার সাথে একত্রে বসবাসকে নরকের সাথে তুলনা করেন। স্বামীর খবরদারি, বকাবকি, রাগ, ক্ষোভ, জেদ দেখতে দেখতে কেউ কেউ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন।ভালোবাসাহীন, উপায়হীন দাম্পত্য কাটিয়ে আসা স্ত্রীরা নতুন করে স্বামীর প্রতি অধিক মনোযোগী হতে চান না। যতটুকু সেবা-যত্ন করে তা দীর্ঘ সময়ে একত্রে বসবাস করা থেকে গড়ে ওঠা মায়া মমতা কিংবা দায়বোধ থেকে। অনেকটা 'আহা বেচারা!' মনোভাব থেকে কিংবা দয়া- করুণা-কৃপা করেন।
যৌবনে স্ত্রী, সন্তানের প্রতি অমনোযোগী স্বামী বার্ধক্যে পৌঁছে স্ত্রীর মনোযোগ পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেন। স্ত্রীকে নিজের কাছে সবসময় দেখতে চান।কোথাও বেড়াতে যেতে দিতে চান না কিংবা বেড়াতে গেলে গেলেও তাড়াতাড়ি চলে আসবার জন্যে বারবার তাগাদা দিতে থাকেন।
সামাজিক নানা কারণে অনেক স্ত্রী- স্বামীর প্রতি সন্দেহ পোষণ করেন।অতীতে বিশ্বাস ভঙ্গকারী স্বামীরা অনেক নাজুক অবস্থায় পড়েন।তাদের অন্য নারীর সাথে হেসে কথা বলাও বিপজ্জনক হয়ে পড়ে।
স্বামী নির্যাতন করে সুখ পাওয়া স্ত্রীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একদা নিপীড়ক এখন নিপীড়নের শিকার হতে দেখা যাচ্ছে। বার্ধক্যে স্ত্রীর সহযোগিতা, সমর্থন, ভালোবাসা পাওয়া পরম সৌভাগ্যের। এমন সৌভাগ্য ক'জনের হয়!