প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৮
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ এবং ব্যক্তির করণীয়
|আরো খবর
বর্তমান বিশ্বে হার্ট অ্যাটাক হলো প্রধান প্রাণঘাতী রোগ। মুহূর্তের মধ্যে ছোবল মেরে নিয়ে যায় একটি জীবন। স্পষ্ট বোঝা যায় কী মারাত্মক এ হার্ট অ্যাটাক নামক ঘাতক ব্যাধিটি। এ হার্ট অ্যাটাকের যদিও অনেক কারণ রয়েছে, তবুও ধূমপান করলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরার ঝুঁকি থাকে বেশি। উচ্চ রক্তচাপের জন্যেও ধূমপান কোনো কোনো ক্ষেত্রে দায়ী বলে বিবেচিত। তামাকের নেতিবাচক প্রভাবগুলো বিশেষ করে ফুসফুসের ওপর সচেতনতা বাড়ানোর জন্যে একটি প্রচারণা সংঘটিত করবে। ফুসফুসের গুরুত্ব এবং একজন ব্যক্তির সার্বিক সুবিধার জন্যে এটি কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে এবারের তামাক দিবসে স্থান পেয়েছে। দেশের ৯০% লোকের ধারণা, তামাক পণ্য সেবনে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে বা হয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জাতীয় পত্র-পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর তামাকজাত পণ্য ব্যবহার ও সেবনে ৬০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। আর এ ধরনের মৃত্যুর পেছনে সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো ধূমপান। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যঝুঁকি হলেও হতো, কিন্তু এতে রয়েছে বিপুল অর্থ অপচয়। অনেকে এটা পরিত্যাগের কথা চিন্তা করে বেশ কয়েকবার ধূমপান ছাড়ার কথা ভাবলেও পারেন নি।
চিকিৎসকদের মতে, ধূমপানের কুফলে শরীরের প্রায় সব অঙ্গই সরাসরি আক্রান্ত হয়। তবে ফুসফুস এবং হৃদযন্ত্রই বেশি আক্রান্ত হয়। ফুসফুস সংক্রান্ত রোগের মধ্যে ক্রনিক ব্রংকাইটিস অন্যতম। এ রোগটির অনেক কারণ রয়েছে। তবুও ধূমপান হচ্ছে এর প্রধানতম কারণ। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে ভোগা একজন ধূমপায়ী হারিয়ে ফেলে তার প্রাণশক্তি। সারাদিন কাশি আর শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকে। এভাবে যে কত শ্রম দিবস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
এক তথ্যে জানা যায়, পুরুষদের ৪৬% মানুষই সিগারেট, বিড়ি, জর্দা বা অন্য কোনো তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এর হার ২৫%।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য মতে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকসেবী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে ২০ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশের হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৩০% জন্যেই দায়ী ধূমপান তথা তামাক ব্যবহার, যা খুবই আশঙ্কাজনক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগ ও মৃত্যু এখন আতঙ্ক। আমাদের দেশের জন্যে একটি বড়ো রকমের চ্যালেঞ্জ।
দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সূত্র মতে, বাংলাদেশে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর ১ লাখ মানুষ মারা যায়। প্রতি বছর ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে। ১২ লাখ মানুষ প্রতি বছর তামাকজনিত ব্যবহারের ফলে ক্যান্সার, স্ট্রোক, হৃদ্রোগ, অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট, লিভার ক্যান্সার ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ২৫% মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে আসে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অন্যদিকে তামাক খাত থেকে বছরে ২,৪০০ কোটি টাকা আয় হলেও নীট ক্ষতি ২,৬০০ কোটি টাকা। আমাদের দেশে পরোক্ষভাবে ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ ধূমপানের শিকার। এর মধ্যে ১ কোটি নারী। কর্মক্ষেত্রে ৬৩% ও পাবলিক প্লেসে ৪৫% মানুষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। শুধু হোটেল, রেস্তোরাঁ ও চায়ের দোকানগুলোতে ২ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হতে হচ্ছে।
প্রাপ্ত সূত্র মতে, দেশে দৈনিক কম হলেও ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা ও বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সিগারেট বা বিড়ি বিক্রি হয়। এ বিক্রিত অর্থে বাংলাদেশের ৫ বছরের নিচে ৭০ লাখ অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুদেরকে দৈনিক একগ্লাস করে দুধ পান করানো সম্ভব অথবা ১ কোটি ৫০ লাখ অভুক্ত মানুষের ৪শ’ ক্যালোরীযুক্ত খাবার দেয়া সম্ভব। তামাক ব্যবহার কমাতে বিশ্বের ৭৭টি দেশে এরই মধ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা দেয়া শুরু করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ করেছে। সুইডেনে সর্বপ্রথম প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ ঘোষণা দেয়া হয়। কিছুদিন পূর্বে উগান্ডা প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ করে। বাংলাদেশেও প্রকাশ্য ও শিশুদের সামনে বা পাশে ধূমপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার মিডিয়াতে সকল প্রকার চটকদার তামাক, তামাকজাত পণ্য ও সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করেছে। আইনের মাধ্যমে প্রকাশ্য একজন ধূমপায়ীকে ১শ’ টাকা জরিমানা ও ৩ মাস জেল দেয়ার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে পিছিয়ে আছে সরকার।
ধূমপান বর্জনে নিচের অভ্যাসগুলো গড়ে তুলুন :
১) কাছে থাকা সিগারেটের প্যাকেট ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলুন এখনই। প্রতিজ্ঞা করুন আর কখনো আর কখনো ধূমপান করবেন না এবং এ প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকুন।
২) একদিন ধূমপান না করে অন্যদিনের সাথে সেইদিনের পার্থক্য অনুভব করার চেষ্টা করুন। এরপর দুদিন, তিনদিন ধূমপান থেকে দূরে থাকুন। তাহলে অভ্যাস গড়ে উঠবে।
৩) আশপাশে যারা এর আগে ধূমপান বর্জন করেছেন তাদের অনুসরণ করুন। তাদের স্বাস্থ্যগত পরিবর্তনটা জানার চেষ্টা করুন।
৪) হিসেব করে দেখুন প্রতিদিন সিগারেট কিংবা তামাকজাত পণ্যের জন্যে আপনার কত টাকা খরচ হয়। তাহলে ধূমপান ছাড়া আপনার জন্যে সহজ হবে। সে টাকা জমিয়ে অন্য খাতে খরচ করতে পারবেন।
৫) উল্লেখযোগ্য কারণ হবে যদি আপনার ধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করতে পারেন। এর ফলে তাদের দেখে আপনার ধূমপান করার ইচ্ছে জাগবে না।
৬) সিগারেট ছাড়ার পর মুখে চুইংগাম কিংবা আদা চিবোতে পারেন। তাহলে ধূমপানের প্রতি আকর্ষণ কমে আসবে।
৭) যখন ধূমপান করতে ইচ্ছা করবে তখন রাস্তায় হাঁটুন বা অন্য কোনো চিন্তা ভাবনায় ডুব মারুন। তাহলে ধূমপানের চাহিদা থাকবে না।
৮) যে কোনো জায়গায় ধূমপান কর্নার থেকে দূরে থাকুন। প্রয়োজনে সেদিকে ফিরে না তাকানোর একটা দৃঢ় অভ্যাস করে ফেলুন।
৯) ধূমপান বিরোধী এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার বই পড়ুন। প্রতিদিন আরেকজন ধূমপায়ীকে কীভাবে ভালো পথে আনা যায় সেটা ভাবুন।
১০) চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে কাউন্সেলিং-এর সহায়তা নিতে পারেন। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, কখনোই মনের ওপর বেশি চাপ প্রয়োগ করবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হওয়ারও সম্ভাবনা থেকে যায়।
আবদুল গনি : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী, চাঁদপুর।