প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:১৮
মামা চাচা খালা ফুফুরা হারিয়ে যাচ্ছে
পিতামাতার পরে সবচেয়ে বেশি আপন হিসেবে যাদেরকে আমরা পেয়েছি তারা হলেন মামা, চাচা, ফুফু ও খালা। বাবা-মায়ের আদর সোহাগের পাশাপাশি শাসন থাকতো। কিন্তু মামা, চাচা, খালা ও ফুফুদের কাছ থেকে শুধুই আদর, সোহাগ,স্নেহ ও মমতা পেয়েছি। এদের কাছ থেকে কোনোদিন বকা খেয়েছি এমনটা মনে করতেই পারি না। নিজের ভাই- বোনদের সাথে এটা সেটা নিয়ে বকাঝকা খেলেও চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো ও খালাতো ভাই- বোনদের কাছে ছিল সাত খুন মাফ। এরা আমাদের কী পরিমাণ আদর সোহাগ দিয়েছে সেটা এখন বলে বোঝানো যাবে না। সেসব মধুর স্মৃতি আজও মনকে নস্টালজিক করে তোলে। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা অনেক দূর পথ চলে এসেছি, কিন্তু পেছনে ফেলে এসেছি সে সকল মধুর স্মৃতি, যা সমাজ থেকে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
ছোটবেলা থেকে এখনো মাঝে মাঝে ভাবি,সম্বন্ধের ক্ষেত্রে ইংরেজ জাতি এতো কৃপণ কেন। তারা মামা, চাচা, ফুফা ও খালু এই চারটি মধুর সম্পর্ককে একটি করে ফেলেছে। এক 'আংকেল'-এ সব শেষ। তেমনি ভাবে মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ও চাচাতো ভাই-বোনদেরকে এতিম করে একটিমাত্র সম্পর্কে টেনে নামিয়েছে তা হলো 'কাজিন'। মাঝে মাঝে ভাবি, ওদের ভাষায় কি শব্দের অভাব, নাকি পরিবারে লোকের অভাব। চারটি সম্পর্কের চারটি শব্দকে তারা একটি শব্দে প্রকাশ করে। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজ কেন জানি বুঝতে পারলাম, মনে হয় তাদের পরিবারের লোকের অভাবে আলাদা আলাদা শব্দের প্রচলন করা হয়নি।। যেমনটা আজকে আমাদের ছেলেমেয়েরা অনুভব করছে। আমাদের নাতি-নাতনিরা হয়তো আরো বেশি কৃপণ হয়ে যাবে। আমাদের পরিবারগুলোতে সম্পদের প্রাচুর্যের সাথে সাথে পারিবারিক বন্ধন ও সম্পর্কের যে প্রাচুর্য ছিলো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিশেষ করে নাতি-নাতনিদের বেলায় সম্পর্কের কৃপণতায় বাংলার শব্দভাণ্ডার সংকুচিত হয়ে ইংরেজদের এক শব্দে পরিণত হয়ে যাবে। আমাদের নাতি-নাতনিরাও একদিন চাচা, মামা, ফুফা ও খালুকে একটি শব্দেই প্রকাশ করবে। কারণ বাস্তবে তাদের পরিবারে ওই চারটি সম্পর্কের লোক থাকবে না। তখন তারা বাধ্য হয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর জন্যে চারটি শব্দের পরিবর্তে একটি শব্দ 'আঙ্কেল' ব্যবহার করবে।
তেমনিভাবে আজ আমাদের ছেলেমেয়েরা যেমন মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো ও খালাতো ভাই-বোনদের আদর- সোহাগ-স্নেহের পরশে বেড়ে উঠতে পারছে না, আমাদের নাতি- নাতনিদের সময় হয়তো এই চারটি সম্পর্কের ভাই-বোনদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। মামা-চাচাদের কাঁধে উঠে মাইলের পর মাইল পথ চলেছি, এমন কোনো আবদার ছিলো না মামা-চাচারা যেটা পূরণ করে দেননি। ফুফাতো খালাতো ভাই-বোনেদের মামাবাড়িতে দল বেঁধে চলতো কী যে হইচই। এক ঘরে গাদাগাদি করে শোয়া, একত্রে বসে খাওয়া, খেলাধুলা, গাছ থেকে পাকা আম, কালো জাম পেড়ে খাওয়া, এসব বিষয় কী বলে বোঝানো যায়। এমনও হতে পারে, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ও চাচাতো ভাই-বোন কেমন জিনিস এটা আমাদের নাতি-নাতনিদেরকে বোঝানো যাবে না। কিংবা এসব দেখার জন্যে, বোঝানোর জন্যে তাদেরকে জাদুঘরে নিয়ে যেতে হবে। তখন হয়তো মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো,খালাতো ভাই বোনদের প্রতিচ্ছবি জাদুঘরে স্থাপন করতে হবে।
আজ হয়তো অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখুন, আজ আমাদের প্রতিটি পরিবারে ছেলেমেয়েদের সংখ্যা কেমন। কারো একটি মেয়ে, কারো বা একটি মাত্র ছেলে। কারো বা দুই ছেলে মেয়ে। তাহলে যে সকল পরিবারে একটি মাত্র ছেলে বা একটি মাত্র মেয়ে আছে, সে সকল পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিবাহ হলে ওই দুই পরিবারের নাতি-নাতনিরা মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো, খালাতো ভাই-বোনদের যেমন পাচ্ছে না, তেমনি মামা, চাচা, ফুফু, খালার আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যাদের দুটি বা তিনটি ছেলে-মেয়ে আছে তাদের নাতি-নাতনিরা কেউ মামা পাবে না, কেউ চাচা পাবে না। আবার কেউ কেউ ফুফু, খালা পাবে না। এভাবেই আমাদের পরিবারগুলো থেকে মধুর সম্পর্কের চাচা, মামা, ফুফু, খালা হারিয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়টি কয়জনে খেয়াল করে।
এমনিতেই আমাদের ছেলেমেয়েদের শৈশবকাল হারিয়ে গেছে। তারা আমাদের মত বন-বাদাড়ে ঘুরেনি, হা-ডু-ডু, কানামাছি, গোল্লাছুট খেলেনি, নদ নদীতে সাঁতার কাটেনি। তাদেরকে সুইমিংপুলে টাকা দিয়ে সাঁতার শিখাতে হচ্ছে। তারা সারাক্ষণ স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টার, টিউটর, কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে। শৈশবকাল কিংবা ছেলেবেলা কী জিনিস তারা সেটা বুঝতেই পারছে না। আমাদের ছেলেমেয়েদের যখন এই অবস্থা, তখন নাতিরা কেমন থাকবে এসব ভাবতে গা শিউরে উঠে। নদীমাতৃক এদেশের ছেলে-মেয়েদেরকে টাকা দিয়ে সাঁতার শেখাতে হবে, আমরা কি এটা ছেলেবেলায় ভাবতে পেরেছিলাম? না, এমনটা হবে আমরা কোনোদিনই ভাবি নি। কিন্তু এখন যখন হয়ে গেছে, এখন কী করতে হবে তাও ভাবছি না।
আধুনিকতার নামে, প্রগতির নামে, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঠেকাতে গিয়ে আমরা ছোট হতে হতে বামুন হয়ে গেলাম। যৌথ পরিবার তো কবেই গেছে, আমাদের মাঝে আর আট- দশটা ছেলেমেয়ের পিতামাতা নেই। এক দুটিতেই কেল্লা খতম। তাহলে মামা, চাচা, ফুফু, খালা কোথা থেকে আসবে। যে কারণে ইংরেজরা 'আংকেল' এবং 'কাজিন' শব্দ ব্যবহার করে পরিবারসমূহকে ছোট করে ফেলেছে। আমরাও আজ পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল সাজতে গিয়ে নিজেদের লেজ ছেঁটে ফেলতে ফেলতে অতি প্রগতিশীলের কাতারে ওঠার চেষ্টা করছি। এভাবেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম রোবটের মতো আচরণ করা শুরু করবে। পরিবার ও পারিবারিক বন্ধন থাকবে না, বেবি কেয়ার সেন্টার চাচা, মামা, ফুফু, খালার জায়গা দখল করবে। পরবর্তী প্রজন্ম কেউ কারো জন্যে হৃদয়ের ভালবাসা, স্নেহ-মমতা অনুভব করবে না। টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন শেষ, এটাই মনে করবে। ওল্ড হোম বা বৃদ্ধাশ্রম হবে সেসব অত্যাধুনিক পিতামাতার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। দাদা-দাদী, নাতি-নাতনিদের সাথে হেসে-খেলে শেষ বিদায় নিবেন-- এমনটি আশা করা যাবে না। কারণ ছেলেমেয়েদেরকে তো সেই পরিবেশ দেওয়া সম্ভব হয়নি।