প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:১৬
কিশোর গ্যাং আর কিশোর জেলে : ভাবুন সকলে
চাঁদপুর শহরে কিশোর গ্যাং আর মেঘনা-পদ্মায় কিশোর জেলের অপতৎপরতা সাম্প্রতিক সময়ে বিবেচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে আমরা মনে করি।জাটকা রক্ষায় মার্চ-এপ্রিল দুমাসের এবং মা ইলিশ রক্ষায় অক্টোবর-নভেম্বরের ২২দিনের অভয়াশ্রম চলাকালে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরায় মেতে ওঠা জেলেদের একটি অংশ থাকে কিশোর, যারা ধরা পড়লেও মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায়। আবার কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট কিশোররা ধরা পড়লে অধিকাংশই মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায় এবং বাকিরা জেলে গেলেও জামিনে ছাড়া পায়। সেজন্যে কিশোর জেলে আর কিশোর গ্যাং হয়ে গেছে দুর্দমনীয়। বিদ্যমান আইনে এদের ব্যাপারে কঠোর হবার সুযোগ না থাকায় এরা শাস্তিতে ছাড় পাচ্ছে এবং ধরা খেলেও শেষ পর্যন্ত ছাড়া পড়ছে। চাঁদপুর কণ্ঠ সহ চাঁদপুরের পত্রিকাগুলোর উল্লেখযোগ্য সংবাদই হয়ে গেছে এখন কিশোর গ্যাং আর কিশোর জেলে। এই সংবাদের কারণে এদের বিরুদ্ধে প্রায়শই পুলিশ সোচ্চার হয়। গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠে ক'টি সংবাদেই কিশোর গ্যাং ও কিশোর জেলের অপতৎপরতার বিষয় এবং পুলিশি অ্যাকশন উল্লেখিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি সংবাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি।
|আরো খবর
সংবাদটিতে লিখা হয়েছে, চাঁদপুর শহরে কিশোর গ্যাংয়ের অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়ে হামলার ঘটনায় দুজন কিশোরকে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করার প্রেক্ষিতে থানায় মামলা হয় এবং দুজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। গত কয়েকদিনের কিশোর গ্যাংয়ের অস্ত্রের শোডাউন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন শহরের অনেক এলাকার বাসিন্দারা। সোমবার (২৮ অক্টোবর) সন্ধ্যায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বাহার মিয়া, থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশ সদস্যরা শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। এ সময় ৮ জন কিশোরকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। অর্ধশতাধিক পুলিশের একটি দল শহরের কালীবাড়ি, কোর্ট স্টেশন, সিএনজি চালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড, রেল লাইন, মিশন রোড, হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, রেললাইন এলাকা, বড় স্টেশন ও প্রেসক্লাব সড়কে অভিযান চালায়। এ সময় সন্দেহভাজন কিশোর ও যুবকদের তল্লাশি করে পুলিশ। হাসান আলী স্কুল মাঠ এলাকা থেকে ইয়াবাসহ বাবুরহাট এলাকার শুকুর শেখের ছেলে শামীম শেখ ওরফে মান্না ও মনির মিজির ছেলে তাসফির মিজিকে আটক করতে সক্ষম হয়।
চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বাহার মিয়া বলেন, শহরের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এটি পুলিশের নিয়মিত অভিযান। আটক কিশোরদের বিষয়ে যাচাই বাছাই শেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং তাদের অভিভাবকদের ডাকা হবে। তিনি আরও বলেন, অভিযানকালে আমরা রেল লাইন এলাকায় সন্ধ্যার পরে কিশোর বয়সীরা যাতে আড্ডা না দিতে পারে সে বিষয়ে স্থানীয়দের সতর্ক করেছি। সেই সঙ্গে শহরের অটোরিকশা স্ট্যান্ডের ব্যবসায়ীদের কিশোর গ্যাং বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্যে বলেছি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল ইয়াসির আরাফাত বলেন, শহরে কিশোর গ্যাং দমাতে মডেল থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় সন্দেহভাজন কয়েকজন কিশোরকে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি মাদকসহ দুজনকে ধরতে সক্ষম হয় পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হবে।
রোববার (২৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় শহরের ছায়াবাণী এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ঘটে। এতে এক পক্ষের দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয় ঢালীর ঘাট এলাকার স্কুল ছাত্র রাশেদ (১৫)। পূর্ব শত্রুতার জেরে তাকে ধাওয়া করে সড়কে ফেলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। পরে তার সঙ্গীরা তাকে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়।
এর আগে শনিবার (২৬ অক্টেবর) রাতে শহরের পুরাণবাজার জাফরাবাদ এলাকায় ওয়াজ শুনতে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আল-আমিন একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সিফাত পাটওয়ারী গুরুতর আহত হয়। তাকেও চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।
গত ৫ আগস্টের পর শহরের কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক ফোরাম, জেলা প্রশাসন, ব্যবসায়ী সংগঠন ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে অংশীজনদের মতবিনিময় সভাগুলোতে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বানকে গুরুত্ব দিয়ে এবং গণমাধ্যম উপর্যুপরি সংবাদ প্রকাশিত হবার প্রেক্ষিতে পুলিশ সুপারের নির্দেশে পুলিশ বারবার অ্যাকশনে যাচ্ছে এবং কিশোর গ্যাংকে পাকড়াও করছে। কথা হলো, পুলিশের বহুবিধ কাজ করার পাশাপাশি কিশোর গ্যাংবিরোধী তৎপরতা কি যথেষ্ট?
কিশোর জেলেদের ধরার পর মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়াতেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারককে ক্ষান্ত কিংবা সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। কথা হলো, এই কিশোরদের যারা নদীতে নামতে উস্কানি দেয়, নিয়োজিত করে, প্রলুব্ধ করে তাদেরকে কি কোনোভাবেই আইনের আওতায় আনা যায় না? আইন প্রয়োগে কৌশল কিংবা পরিস্থিতিগত চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনীয়তাকে কি কোনোভাবেই গুরুত্ব দেয়া যায় না? আমাদের মতে, আইনের গতানুগতিক ব্যবহারে প্রচারও হয় সাদামাটা, যেটা অপরাধীকে অপরাধের পুনরাবৃত্তিতে নিবৃত্ত হতে চাপ সৃষ্টিতে তেমন কাজ করে না। উদাহরণস্বরূপ, বাল্য বিয়েতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে বরকে শায়েস্তা করলে সেটা যতোটা না প্রভাব ফেলে, তারচে' বাল্য বিয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট মেয়ে ও ছেলের বাবা/মা বা অন্য অভিভাবক, ঘটক, ম্যারিজ রেজিস্ট্রার সহ সংশ্লিষ্ট অন্যদেরকেও শায়েস্তা করলে সেটা সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। যেটি শাহরাস্তির সাবেক এক ইউএনও বারবার করে স্থানীয় গণমাধ্যম শুধু নয়, জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমেও ভালো কাভারেজ পান। ফলে এর ইতিবাচক প্রভাবে বাল্য বিয়ে অনেক হ্রাস পায় শাহরাস্তিতে। আমরা মনে করি, কিশোর জেলে ও কিশোর গ্যাং অভিভাবকের উদাসীনতা, শৈথিল্য, প্রশ্রয় কিংবা উস্কানিতে, নয়তো কোনো গডফাদারের মদদে অপরাধ করে। এরা বস্তুত ব্যবহৃত হয়। এজন্যে উস্কানিদাতা ও মদদদাতাকে আইনের বিশেষ ও সর্বোচ্চ প্রয়োগে কীভাবে শাস্তির মুখোমুখি করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে। অন্যথায় বাস্তবতা ও সমকালীন চাহিদার আলোকে বিদ্যমান আইনের সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সমাজবিজ্ঞানী, সমাজ বিশ্লেষক, গবেষক ও অপরাধ বিজ্ঞানী/ বিশেষজ্ঞদেরকেও কিশোর অপরাধ দমন, নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্মূল বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে তাদের পরামর্শ/অভিমত ব্যক্ত করার ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে।